নাটক-দ্য টেম্পেস্টের মহড়াকক্ষে by জাহীদ রেজা নূর

সেদিন কালবৈশাখীর সঙ্গে একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল। এরপর যখন মৃদু শীতল রাজপথ দিয়ে আমরা শিল্পকলা একাডেমীতে পৌঁছালাম, তখন মহড়াকক্ষে ঝড়! এ ঝড়েই ডুবে যাবে রাজা অ্যালোনজোর জাহাজ। প্রসপেরোর জাদুমায়া শুরু হয়ে যাবে। সেদিন ২ মে।


নাসির উদ্দীন ইউসুফ বসে আছেন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে। কোনো কথা বলছেন না। মাঝে মাঝে হাতের ইশারায় কুশীলবদের করণীয় কী, তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। দ্য টেম্পেস্ট নাটকের মহড়া চলছে। আরেক দিন মহড়ার পরই ঢাকা থিয়েটারের এ দলটি চলে যাবে যুক্তরাজ্যে। ৭ ও ৮ মে গ্লোব থিয়েটারে মঞ্চস্থ হবে এ নাটক। তাই কীভাবে সুচারু-সুকারু করা যায় নাটকটি, তারই মহড়া যেন!
ইতিমধ্যে ২৭ এপ্রিল একবার জাতীয় নাট্যশালায় হয়ে গেছে অভিনয়। যাঁরা ভেবেছিলেন শেকসিপয়ারের নাটকে পাশ্চাত্যের আধিপত্য থাকবে, তাঁরা ধাক্কা খেয়েছেন। একেবারেই আমাদের লোকজ ধারায় নির্মিত হয়েছে অভিনয়ের শরীর। চড়া বর্ণিল রঙের ঘনঘটায় মঞ্চ আলোকিত। মণিপুরী থিয়েটার আর পাঁচালি রীতিতে গীতল হাওয়া বয়ে গেল যেন দর্শকের মনজুড়ে।
২ মে মহড়ার সময় নির্ধারিত পোশাক ছিল না। যারা নাটকটি মঞ্চে দেখেছি তারা খেয়াল করেছি, বর্ণিল মঞ্চসজ্জার বিপরীতে কুশীলবদের পোশাকে হালকা রং। প্রাচ্যের নরম স্বভাবের মানুষের কথা মনে রেখেই এ পোশাক-পরিকল্পনা। মহড়া দেখতে দেখতে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, কেমনভাবে নেবে পাশ্চাত্যের মানুষ এ নাটকটিকে? নাসির উদ্দীন ইউসুফ বললেন, ভাষা না বুঝলেও দেহভাষাতেই সবার কাছে পৌঁছে যাবে নাটকটি। এখানে একধরনের নাটকের নতুন ভাষা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
বলি, বাচ্চু ভাই, আপনি তো ঢাকার মানুষ। লোকজ ধারায় একের পর এক নাটক কীভাবে করে যাচ্ছেন?
‘মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামের হূৎস্পন্দনটি খুঁজে পাই। এরপর গ্রাম থিয়েটার করতে গিয়ে আরও কাছাকাছি আসি। বাংলার নিজস্ব একটা ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতি আছে, তার আলোকেই আধুনিক নাট্যভাষা তৈরি করা যায়।’ বললেন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ।
কুশীলবদের সবার কণ্ঠই সুরেলা। তাল-লয়-ছন্দের সঙ্গে নিমেষেই মিশে যাচ্ছেন তাঁরা। সেটা ‘আমার রাজ্যে আমিই প্রজা দুঃখ কোথায় রাখি।’ কিংবা ‘দিনের একটা বিশেষ সময় ঘুমিয়ে সে রয়, সেই সুযোগে একটা পাথর মারলেই হয়’ হোক, কিংবা একেবারে ছায়াছবি থেকে সরাসরি নেওয়া ‘এই মন তোমাকে দিলাম, এই প্রেম তোমাকে দিলাম’, ‘তুমি চোখের আড়াল হও, কাছে কি বা দূরে রও, মনে রেখো আমিও ছিলাম’ই হোক, পূর্ণ ক্ষমতা উজাড় করে দিয়ে কুশীলবেরা মহড়াকক্ষ মাতিয়ে দিচ্ছেন।
গ্লোব থিয়েটারে বাংলাদেশের একটি নাট্যদল বাংলা ভাষায় নাটক করছে, এটি এক অসাধারণ ঘটনা। পৃথিবী থেকে বাছাই করা ৩৭টি দলের মধ্যে ঢাকা থিয়েটার একটি। ৭ মে যখন নাটকটি মঞ্চে উঠবে, তখনো আকাশে সূর্য থাকবে। মাইক ব্যবহার করা যাবে না। আলো বলতে মধ্যবিরতির পর চারটি হ্যালোজেন লাইটই ভরসা। তাই লোকজ আঙ্গিকের এ নাটকটিকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে ভেতরকার শক্তি নিয়েই।
নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বললেন, ‘শেকসিপয়ার আসলেই মাস্টার। ৪০০ বছর আগেই তিনি ভাষা কেড়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। শঙ্খটা অবশ্য শেকসিপয়ারে নেই। ক্যালিবান যখন নিজ দেশে রাজা হলো, তার অভিষেক এসব আমি ভেবেছি। ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তির একটা আবহ আনতে চেয়েছি।’
নানা ধরনের দেশীয় বাদ্যের ব্যবহার নাটকটিকে সংগীতময় করেছে, তবে মাঝে মাঝেই ঢোলের অনবদ্য বাদন মন ভরিয়ে দেয়।
মহড়া শেষ হলে পুরি-চায়ে মন দেন অভিনয়শিল্পীরা। তাঁদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘খুব ক্লান্তি লাগছে?’
‘না। আরেকবার পুরো মহড়াটা করতে পারব।’ বললেন একজন।
এটাই বোধ হয় গ্রুপ থিয়েটারের মূল শক্তির জায়গা। নাসিরউদ্দীন ইউসুফ যেন নাটকে এবং নাটকের বাইরে সেই শক্তির কথাই বারবার বলতে চেয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.