চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে সাড়ে ২৮ হাজার একর বনভূমি জবরদখল! by প্রণব বল

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় গত ২০ বছরে সাড়ে ২৮ হাজার একর উপকূলীয় জমি চিংড়িঘেরের জন্য ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। তবে বন বিভাগ বলছে, এই পুরো জমি বাস্তবে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এবং এগুলো জবরদখল করা হয়েছে। বন ধ্বংসের অভিযোগে তারা কয়েক শ মামলাও করেছে।


মামলায় সাংসদ, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও কক্সবাজারের মহেশখালীতে বনাঞ্চল উজাড় করে চিংড়িঘের করার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বন দখলের পর জেলা প্রশাসন থেকে ইজারার কাগজ বের করে এনেছেন। শুধু মহেশখালীতেই বন উজাড়ের ঘটনায় ৩৭১টি মামলা করেছে বন বিভাগ। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা এক হাজার ৪০৬ জন। এ উপজেলায় বন উজাড় হয়েছে নয় হাজার ৭৪৫ একর।
উপকূলীয় বন বিভাগের কাগজপত্রে গত ২০ বছরে চট্টগ্রামে ১০ হাজার ১৬২ একর ও কক্সবাজারে ১৮ হাজার ৪৪২ একর উপকূলীয় বনভূমি জবরদখল হয়েছে বলে উল্লেখ আছে। বর্তমানে কক্সবাজারে প্রায় ১৮ হাজার একর ও চট্টগ্রামে ৫২ হাজার একর উপকূলীয় বনাঞ্চল অবশিষ্ট আছে।
দুই জেলার অবশিষ্ট এই উপকূলীয় বনাঞ্চল জুনের মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণার কথা থাকলেও অগ্রগতি খুব সামান্য। বরং এর মধ্যে কক্সবাজার জেলায় আরও প্রায় ছয় হাজার একর বনভূমি চিংড়িঘেরের জন্য ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ, বন মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের আপত্তি সত্ত্বেও জেলা প্রশাসন দুটি বনভূমি ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে বলে বন বিভাগ অভিযোগ করেছে।
উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন সংরক্ষক (ডিএফও) সুনীল কুমার কুণ্ডু প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই জেলায় এ পর্যন্ত সাড়ে ২৮ হাজার একর বনাঞ্চল জবরদখল হয়েছে। বেশির ভাগই গেছে চিংড়িঘেরের দখলে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা প্রশাসনের এই ইজারার বিষয়ে নানা সময়ে আপত্তি জানিয়েছি। এখনো আপত্তি দিয়ে আসছি।’
উপকূলের ইজারাদান প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে বন বিভাগের সঙ্গে আমাদের পরস্পরবিরোধী কিছু বক্তব্য রয়েছে। তারা যেসব এলাকা তাদের বলে দাবি করে, সেটা আমরা মানি না।’ তিনি বলেন, উপকূলের কিছু কিছু জমি চিংড়িঘেরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়।
উপকূলীয় বন বিভাগের নথিপত্রে দেখা যায়, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে চার হাজার ৩৪৮ একর, মিরসরাইতে দুই হাজার ৬২ একর, সীতাকুণ্ডে এক হাজার ৯০০ একর, আনোয়ারায় ২৯৩ একর, সিটি করপোরেশন এলাকায় ১০৪ একর ও বাঁশখালীতে এক হাজার ৫৩৩ একর ‘উপকূলীয় বন দখল করে চিংড়িঘের’ করা হয়।
নথিমতে, কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় ৩৪৯ একর, পেকুয়ায় এক হাজার ৬০৫ একর, চকরিয়ায় চার হাজার ৪১১ একর, কক্সবাজার সদরে ৯২০ একর ও টেকনাফে এক হাজার ৪১০ একর বন জবরদখল হয়েছে।
যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ: মহেশখালীতে উপকূলীয় বনের গাছ কেটে চিংড়িঘের করার অভিযোগে ২০০৭ সালে মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের সাবেক সাংসদ বিএনপির নেতা আলমগীর মো. মাহফুজ উল্লাহ ফরিদের বিরুদ্ধে বন বিভাগ মামলা করে।
মহেশখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিএনপির নেতা আবু বক্করের বিরুদ্ধে ঘটিভাঙায় এক হাজার ৬৫০ একর বন ধ্বংস করে চিংড়িঘের করার অভিযোগ এনে ২০০৮ সালে মামলা করা হয়। মামলাটি বিচারাধীন।
জানতে চাইলে আবু বক্কর বলেন, ‘আমরা যেখানে চিংড়িঘের করেছি, সেখানে বন ছিল না। আর জেলা প্রশাসক লিজ দিয়েছেন বলে আমরা ঘের করেছি। ইজারা নেওয়ার পর বন বিভাগ বলছে ওটা তাদের জায়গা। এসব কারণে এক-এগারোর সময় রাজনীতিকদের হয়রানি করার জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়।’
এ ছাড়া সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল হকের ছেলে হাবিব উল্যা, ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল খালেক, ইউপি সদস্য বশির আহম্মদ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ভাই মাকসুদ সিকদার, ইউপি সদস্য আবদুল গফুর ওরফে নাগু মেম্বার, বাদশা মিয়া মেম্বার, জামায়াতের নেতা ছৈয়দুল হক সিকদার, সাবেক চেয়ারম্যান মো. শরীফ বাদশা, সাবেক সাংসদ আলমগীর ফরিদের ভাইপো এনায়েত উল্যা, শাপলাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল খালেক প্রমুখের বিরুদ্ধে বন দখল করে চিংড়িঘের করার অভিযোগে বন বিভাগ বিভিন্ন সময়ে মামলা করে।
চট্টগ্রাম জেলায় উপকূলীয় বন ধ্বংসের অভিযোগে বাঁশখালীতে সরল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আমিনুর রশিদ চৌধুরী, তাঁর ভাই হারুনুর রশিদ সিকদার ও মামুনুর রশীদ সিকদার, কুতুবখালীর চেয়ারম্যান মো. বশির, সীতাকুণ্ডের সাংসদের ছেলে এস এম আল মামুন, মিরসরাইতে মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বন বিভাগ বিভিন্ন সময়ে মামলা করে। এস এম আল মামুনের বিরুদ্ধে বন ধ্বংস করে শিপইয়ার্ড নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। কুতুবখালীর চেয়ারম্যান বশির বন ধ্বংসের অভিযোগে কারাগারেও ছিলেন।
মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত অমান্য: গত বছরের ১৮ মে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সভায় ২০১২ সালের জুনের মধ্যে অবশিষ্ট বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। এতে বলা হয়, ‘১৯২৭ সালের বন আইনের ৪ ধারায় প্রকাশিত গেজেটের অন্তর্ভুক্ত জমি ওই আইনের ৬ ধারা এবং পরবর্তী স্তরের কার্যক্রম সম্পন্ন করে ২০ ধারায় প্রজ্ঞাপন জারির জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকগণ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
এর আগে ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভায় উপকূলীয় বনভূমি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বন্দোবস্ত না দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
ডিএফও সুনীল কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘জুন মাসের মধ্যে সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণার প্রক্রিয়া শেষ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু অগ্রগতি খুব বেশি হয়নি। কক্সবাজারের বনভূমিগুলো ৪ ধারায় বিজ্ঞপ্তিত। এরপর ৬ ধারা ও সর্বশেষ ২০ ধারায় বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষিত হবে। চট্টগ্রামের কিছু বনভূমি ৬ ধারায় বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে।’
চট্টগ্রামে বর্তমানে ৫২ হাজার ৮১৬ একর বনভূমির মধ্যে মাত্র পাঁচ হাজার ৪০০ একর ৬ ধারায় বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। একইভাবে কক্সবাজারে অবশিষ্ট ১৭ হাজার ৭৫৮ একর বনভূমির মধ্যে ৬ ধারায় বিজ্ঞপ্তি জারির কোনো অগ্রগতি নেই।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহম্মদ বলেন, ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণার ব্যাপারে অগ্রগতি হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের কাজ এগিয়ে চলেছে। তবে বন বিভাগের দাবি অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ে যাচাই-বাছাই চলছে।’
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা ৬ ধারা জারির প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। আশা করি, শিগগির ৬ ধারা জারি হয়ে যাবে।’

No comments

Powered by Blogger.