জমির দখল নিয়ে যত বিবাদ by তানজিম আল ইসলাম

০১. আবুল হাশেম গাজীপুর জেলায় একখণ্ড জমি কেনেন। জমি কেনার পর যখন তিনি দখলে গেলেন, তখন পাশের জমির এক মালিক দলবলে এসে আবুল হাশেমকে জমি ছেড়ে দিতে বলেন এবং জমির দখল বুঝিয়ে দিতে বলেন। পরপর কয়েকবার জমি দখলের চেষ্টাও করেন ওই লোক।


আবুল হাশেম পড়েন বিপদে। তিনি যাঁর কাছ থেকে জমি কিনেছেন, তাঁর কাছে ধরনা দেন। বিক্রেতা সব কাগজপত্র ও দলিল-দস্তাবেজ দেখিয়ে প্রমাণ দিলেন যে এ জায়গায় কোনো ঝামেলা নেই। ওই লোক ভুয়া দলিল করে জমি দখলের চেষ্টা করছেন। আবুল হাশেম বুঝতে পারছেন না, এ মুহূর্তে তাঁর কী করা উচিত।

০২.
বারেক সাহেব বিদেশে থাকেন দীর্ঘ দিন ধরে। দেশে তাঁর আপন ছোট ভাই থাকেন। এই ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি রয়েছে। প্রায় তিন-চার বছর ধরে তাঁদের জমির কিছু অংশে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে গ্রামের প্রভাবশালী এক লোক কিছু অংশের মালিকানা দাবি করে আসছেন। জমির কিছু অংশে বসতভিটা করেছেন বারেক সাহেব। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা, তাঁর পুরো জায়গায় নতুন করে দালান তৈরি করবেন। কিন্তু প্রভাবশালী লোকটির দখল থেকে জমির অংশ ছাড়াতে পারছেন না কিছুতেই। এ দখল তিনি কীভাবে ফিরে পাবেন, এ নিয়ে তিনি পড়েন দুশ্চিন্তায়।
জমির দখল নিয়ে এমন ঘটনা অহরহ ঘটে। দখলকেন্দ্রিক বিবাদগুলোর নিষ্পত্তি কীভাবে করতে হয়, তা জানা নেই সাধারণ লোকের। ফলে নিজের জায়গাটুকু বেদখল হয়ে যায়। জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটে। আইন আছে শক্তিশালী এ বেদখল ঠেকাতে, কিন্তু আইনের আশ্রয় কীভাবে নিতে হবে, কীভাবে মিলবে প্রতিকার, এ যেন বড় অজ্ঞতা সাধারণের কাছে। আবার জায়গাজমি দখল নিয়ে কোর্ট-কাছারিতে দৌড়াতে দৌড়াতেও যেন জীবন বিপন্ন। বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকে। পর্যায়ক্রমে মামলার ধাপ কবে পেরিয়ে যাবে, মিলবে প্রতিকার—এ যেন এক দুর্বিষহ প্রতীক্ষা। কিন্তু নিজের জমি বেদখল হয়ে যাবে, আর চেয়ে থাকতে হবে অসহায়ের মতো—এ তো হতে পারে না।
জমির দখল নিয়ে ফৌজদারি এবং দেওয়ানি দুভাবে প্রতিকারের উপায় খোলা আছে। আমরা যদি প্রথম উদাহরণটি দেখি যে আবুল হাশেমকে দখলচ্যুত করার জন্য চেষ্টা করছে একদল লোক। এতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আবুল হাশেম ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চাইতে পারেন। এ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চাইতে হবে প্রথম শ্রেণীর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। আর এ মামলা করতে হবে বেদখল হয়ে গেলে কিংবা বেদখল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে এর দুই মাসের মধ্যে। কোনো মামলা করলে ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় পক্ষের ওপর সমন জারি করবেন। পরবর্তী সময়ে উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনবেন এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে সম্পত্তি দখলদার নির্ণয় করবেন। প্রয়োজনে সরেজমিনে তদন্তের আদেশ দিতে পারেন পুলিশকে এবং এর ভিত্তিতে প্রকৃত দখলদার নির্ণয় করবেন। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যে পক্ষের দখল যথার্থ বলে মনে হবে বা তিনি যে পক্ষকে দখলকার বলে সাব্যস্ত করবেন, আদেশ দ্বারা যে পক্ষকে আইনানুগ উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত আইনানুগ তিনি দখলকার বলে গণ্য হবেন। তবে ১৪৫ ধারায় প্রতিকার চাইতে গেলে এখানে স্বত্ব বা মালিকানা দাবি করা যাবে না। এটি শুধু প্রকৃত দখলদার নির্ণয় করতে হবে। স্বত্ব দাবির জন্য দেওয়ানি আদালতের আশ্রয় নিতে হবে।
দ্বিতীয় উদাহরণটির ক্ষেত্রে বলা যায়, বারেক সাহেব বা তাঁর ভাই স্বত্ব ঘোষণা চেয়ে এবং দখল চেয়ে দেওয়ানি আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন।
ভূমি থেকে অবৈধভাবে দখলচ্যুত হলে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ও ৯ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার পেতে পারেন। এ আইনের ৮ ধারানুযায়ী সুনির্দিষ্ট স্থাবর সম্পত্তি দখলের অধিকারী ব্যক্তি দেওয়ানি কার্যবিধি অনুসারে নির্ধারিত পদ্ধতিতে পুনরুদ্ধারের আবেদন করতে পারেন। তবে এ ধারানুযায়ী, দখলচ্যুত ব্যক্তিকে ওই ভূমিতে তাঁর স্বত্ব আছে বলে প্রমাণ দিতে হয়; নইলে এ ধারানুযায়ী প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হয় না।
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারায় উল্লেখ আছে, যথাযথ আইনগত পন্থা ব্যতীত যদি কোনো ব্যক্তি তাঁর অসম্মতিতে বেদখল হন, তবে তিনি বা তাঁর মাধ্যমে দাবিদার কোনো ব্যক্তি মোকদ্দমার মাধ্যমে এর দখল পুনরুদ্ধার করতে পারেন, যদিও এমন মোকদ্দমায় অপর কোনো স্বত্ব দাবি করা হতে পারে।
এ ধারানুযায়ী মামলা করার ক্ষেত্রে বাদী শুধু দখলচ্যুত হয়েছেন—এ মর্মে প্রতিকার চাইতে পারেন, স্বত্ব বা দখল প্রমাণেই দরকার নেই। ৮ ধারার সঙ্গে ৯ ধারার এখানেই পার্থক্য হচ্ছে, ৯ ধারার ক্ষেত্রে যেসব দিক বিবেচনা করা হয়, সেগুলো হলো: বাদী জমিটি দখল করে আসছিলেন কি না। বিবাদী তাঁকে জোরপূর্বক বেদখল করেছেন কি না, বিবাদী বেআইনিভাবে জমিতে প্রবেশ করেছেন কি না। তবে ৯ ধারার প্রতিকারের ক্ষেত্রে তামাদি আইন অনুযায়ী, বাদীকে অবশ্যই বেদখল হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে মামলা করতে হবে। অন্যথায় এ ধারায় মামলা করার অধিকার হারাতে হবে তাঁকে।
৮ ধারার স্বত্ব প্রমাণসহ মামলা করার ক্ষেত্রে বেদখল হওয়ার পর থেকে ১২ বছরের মধ্যে মামলা করার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে এসব প্রতিকারের ক্ষেত্রে মূল্য বাবদ নির্দিষ্ট এখতিয়ারাধীন আদালতে মামলা করতে হবে।
দখল পুনরুদ্ধার মামলার ক্ষেত্রে, মূলত সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ধারানুযায়ী যেসব মামলা করা হয়, সেগুলোকে স্বত্ব সাব্যস্ত খাস দখলের মামলা বলা হয়।
এতে অবশ্যই স্বত্ব প্রমাণসহ খাস দখলের ঘোষণা চাইতে হবে। মামলার জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিবাদী যদি এক বা একাধিক দলিল দাখিল করেন, তাহলে এ ক্ষেত্রে পৃথক দলিল বাতিলের মোকদ্দমার দরকার পড়ে না। কারণ, ৮ ধারাতেই সব বিষয়ে স্বত্ব প্রমাণসহ দখলের ব্যাপারে প্রতিকারে সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শুধু স্বত্ব ঘোষণার মামলাও বাদী করতে পারেন না, কারণ এ ধারা অনুযায়ী দখল উদ্ধার ছাড়া স্বত্ব ঘোষণা চাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে জমির মূল্য বাবদ অ্যাড-ভ্যালোরেম (মূল্যানুপাতে) কোর্ট ফি দিতে হবে।
৯ ধারানুযায়ী, বেদখল হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে মামলা করতে হবে। এতে স্বত্ব প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না। এতে সম্পত্তির মূল্য অনুসারে যে কোর্ট ফি, অর্থাৎ অ্যাড-ভ্যালোরেম কোর্ট ফির অর্ধেক পরিমাণ কোর্ট ফি দিতে হবে। তবে সরকারের বিরুদ্ধে এ ধারায় মোকদ্দমা চলে না।
৮ ও ৯ ধারার ক্ষেত্রে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য যদি বাদী মনে করেন, তাঁর নালিশি জমিটি দখলকৃত বিবাদীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাহলে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাইতে পারেন পৃথক আবেদনের মাধ্যমে।
tanzimlaw@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.