শিক্ষাঙ্গন-পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চাকরি নিরাপদ নয়! by সুস্মিতা চক্রবর্তী

বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে এভাবে উপাচার্য মহোদয় ধূলিসাৎ করে দিতে পারেন না। এটা উপাচার্য হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে উপাচার্য-পদের মহত্ত্ব ও মর্যাদাকে খাটো করে; প্রশ্নবিদ্ধ করে


সম্প্রতি রাবির উপাচার্য নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের তিনজন তরুণ শিক্ষকের নিয়োগ (অ্যাডহক-নিয়োগ) যথাসময়ে নবায়ন করেননি। বিভাগীয় সভাপতি, কলা অনুষদের ডিন যথাযথভাবেই সুপারিশ করে ফাইল পাঠিয়েছিলেন। সেই ফাইল উপাচার্যের দফতরে পড়ে আছে। অথচ এর আগে আরও একবার তাদের নবায়ন হয়েছে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বর্তমান উপাচার্যের আমলেই। এই তিন শিক্ষক এক বছর আগে নিজেদের যোগ্যতার মাধ্যমে এই উপাচার্যের সময়েই নিয়োগ পেয়েছিলেন। এই তিন শিক্ষক নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। এখান থেকে ভালো রেজাল্ট করে তারা নিজেদের বিভাগেই যোগদান করেছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের চিনি অন্তত এই মর্মে যে, তারা বিভাগের পাঠদানসহ আরও নানাবিধ ইতিবাচক কাজে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভাগেই কাটান। কেউ আমার পারিবারিকভাবে বা পূর্ব পরিচিত নন। কিন্তু প্রায় দিনই আমি দেখেছি তাদের নিজ বিভাগের সহকর্মী শিক্ষকদের সঙ্গে। এমনকি কখনও কখনও আমি সন্ধ্যার পরও যখন বিভাগে নিজ কক্ষে বসার জন্য আসি তখনও দেখেছি তারা বিভাগীয় শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন।
এহেন তিন তরুণ শিক্ষককে উপাচার্য মহোদয় যেভাবে চাকরিচ্যুত করার দিকে এগোচ্ছেন তাতে করে এটাকে নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকদের সভাপতি-অপসারণ-আন্দোলনের পরিণামে কঠোর শাস্তি প্রদান হিসেবেই বিবেচনা করতে হচ্ছে। উপাচার্য পদটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। পদটির কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। যে বিষয়কে কেন্দ্র করে এই তিন শিক্ষক আজ তাদের চাকরি হারাতে চলেছেন, সেটা সর্বোপরি অমানবিক। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হুমকিস্বরূপ।
তিন মাস আগে রাবির নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষকরা তাদের বিভাগীয় সভাপতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমরা যেহেতু পাশাপাশি বিভাগ ফলে খুব ভালো করেই জানি যে, ওই বিভাগটি সেদিন তাদের অনেক ন্যায্য দাবিকে সামনে নিয়ে নিরুপায় হয়ে আন্দোলনে নামে। তখনকার সময়ের এই আন্দোলন ছিল দল-মতের তথা এখানকার শিক্ষক বা দলীয় রাজনীতিতন্ত্রের একদম বাইরে। সেখানে বিভাগের সব শিক্ষক একত্রে রাস্তায় অবস্থান নিয়েছিলেন; বিভাগীয় শতভাগ শিক্ষার্থীর এতে আন্তরিক যুক্ততা ছিল। আন্দোলনে তারা সুনির্দিষ্ট লিখিত দাবি পেশ করেছিলেন। রাবির কর্তৃপক্ষসহ অনেকের কাছেই তারা তাদের ন্যায্য দাবি তুলে ধরেছিলেন। অত্যন্ত সঠিকভাবে (গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে) সহনশীলতার সঙ্গে তারা আন্দোলনটি সেই সময় চালিয়েছেন। টানা ক'দিন সেই আন্দোলন চলে এবং ওই বিভাগের শিক্ষকরা নিজেদের সম্মিলিত দাবি আদায়ের লক্ষ্যে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে ক'দিন সকাল-সন্ধ্যা অবস্থান নিয়েছিলেন। সেখানে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনরত অবস্থায় গান-নাটক-লাঠিখেলা প্রভৃৃতি সৃজনশীল কাজ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে আন্দোলন চালিয়েছেন। কোনো ধরনের উস্কানিমূলক আচরণ তারা করেননি।
আগেই বলা হয়েছে, আজকের যে তিন তরুণ শিক্ষক চাকরি খোয়াতে চলেছেন তারা ওই বিভাগেরই শিক্ষার্থী ছিলেন। তারা যখন দেখলেন তাদের বিভাগের বলতে গেলে সব শিক্ষক (১৮ জনের মধ্যে ১৬ জন) আর প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী নিজেদের বিভাগের কল্যাণে কষ্ট স্বীকার করে আন্দোলন করছেন তখন ওই তিন তরুণও তাদের সহকর্মী-শিক্ষার্থীদের পাশে অত্যন্ত ন্যায্যভাবে, মানবিকভাবে ওই আন্দোলনে অবস্থান নিয়েছিলেন। বিষয়টাকে কোনোভাবেই দলীয় ক্ষমতার রাজনীতি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা একদমই ঠিক হবে না।
সেই সময়ে কেবল ওই বিভাগই নয়, রাবির বেশ কিছু সাধারণ শিক্ষক এবং শিক্ষক সমিতির ও ক্ষমতাসীন শিক্ষক দলের বিভিন্ন পদে থাকা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকদেরও এই আন্দোলনের বিষয়ে প্রকাশ্য, নৈতিক সংহতি ছিল। আমি নিজে প্রায় দিনই ঘুরে ঘুরে দেখেছি আর বোঝার চেষ্টা করেছি এবং যখন বুঝতে পেরেছি যে, এই আন্দোলন কোনোভাবেই অন্যায্য নয়, কেবল তখনই তাদের পাশে একজন সহকর্মী হিসেবে নীতিগতভাবে সংহতি জানিয়েছিলাম আমরা কেউ কেউ। প্রশাসনিক রাজনীতির একট বড় অংশ বিষয়টাকে কেবল দলীয়ভাবে বিবেচনা করেছেন। ভুল বুঝেছেন। উপাচার্যকেও ভুল বুঝিয়েছেন। এ আন্দোলন কোনোভাবেই সরকারবিরোধী আন্দোলন বা উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন ছিল না। বরং এটি ছিল সেই আন্দোলন, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের শিক্ষকরা নিজেদের সব ভেদাভেদ ভুলে বিভাগীয় সমস্যা নিরসনে, বিভাগীয় শিক্ষকদের আত্মসম্মান রক্ষার্থে আন্দোলনে নেমেছিলেন। অথচ আজ সেই আন্দোলনটিকে বর্তমান উপাচার্য মহোদয় স্রেফ দলীয় আন্দোলন বা প্রশাসন-বিরুদ্ধ আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা কিছুতেই চলতে পারে না।
এই আন্দোলন নিয়ে একটা 'তদন্ত কমিটি'ও হয়েছিল, যাদের এ বিষয়টি খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে রিপোর্ট দেওয়ার কথা জুলাই মাসের মধ্যে। রিপোর্টে কী আছে জানি না। তবে রিপোর্টে যদি কোনো নেতিবাচক কিছু থেকেও থাকে তবে তা ওই বিভাগের সব শিক্ষক আর শিক্ষার্থীরই প্রাপ্য কিন্তু সেগুলোর আগে উপাচার্য স্বয়ং তার ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটালেন এভাবে! এ রকম একটা নাজুক অবস্থায় এটা কোনোভাবে শোভনীয় হলো না। বিশেষ করে তিনজন শিক্ষক স্রেফ উপাচার্যের এককেন্দ্রিক ক্ষমতার কাছে অন্যায়ভাবে এই নিপীড়নের শিকার হতে যাচ্ছেন।
বর্তমান উপাচার্য যদি ভুল বোঝা নিয়েই নাট্যকলা আর সঙ্গীত বিভাগের আন্দোলনটিকে বিবেচনা করেন, তবে এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অন্য শিক্ষকদেরও (যারা তখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ ধরনের আন্দোলনের প্রতি সহকর্মীসুলভ সমর্থন দিয়েছেন) তাদের বিরুদ্ধেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক। তখনকার সময়ে যাকে কেন্দ্র করে রাবির নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগ আন্দোলন চালিয়েছিল তিনি নানাবিধ গুণের অধিকারী হলেও নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষক (আন্দোলনের ফলে এখন আবার সেই বিভাগেই ফিরে গেছেন)। তিনি তার নতুন বিভাগের সব সহকর্মীকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে, সঙ্গে নিয়ে, সবার মতামতের ভিত্তিতে রাবির নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগটিকে চালাতে যে ব্যর্থ হয়েছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয় কারোরই। একটা বিভাগের সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে ক্ষেপিয়ে, নিজের অসহিষ্ণুতা দিয়ে এবং কেবল ক্ষমতা-কর্তৃত্ব দিয়ে কোনো বিভাগ বা বিশ্ববিদ্যালয় চালানো যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে এভাবে উপাচার্য মহোদয় ধূলিসাৎ করে দিতে পারেন না। এটা উপাচার্য হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে উপাচার্য-পদের মহত্ত্ব ও মর্যাদাকে খাটো করে; প্রশ্নবিদ্ধ করে। ফলে এই তিনজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে নেওয়া 'ভুল বোঝাবুঝিজনিত বর্তমান সিদ্ধান্তকে' আরেকবার বিবেচনা করার জন্য মাননীয় উপাচার্যকে সবিনয়ে অনুরোধ করছি। তিনি নিজেও অন্যায়ের প্রতিবাদে মতপ্রকাশের দায়ে এক সময়ে জেল-নিপীড়নের মতো বড় ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। তিনি চাইলে বিষয়টাকে প্রশাসকসুলভ নয় বরং শিক্ষকসুলভ অনুভূতি থেকে মানবিকভাবেও অনুধাবন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে মাননীয় উপাচার্যের উচিত হবে সন্তানের বয়সী এই তিন তরুণ ও জনপ্রিয় শিক্ষকের চাকরি যথাযথভাবে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় নবায়ন করা, তদন্ত কমিটিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং আপামর শিক্ষক ও শিক্ষক সমিতির পরামর্শক্রমে যাবতীয় সংকট নিরসন করা। শিক্ষক সমিতি এরই মধ্যে ওই তিন শিক্ষকের চাকরি নবায়নের আহ্বান জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপাচার্যকেও তারা তা অবহিত করেছেন।

সুস্মিতা চক্রবর্তী : সহকারী অধ্যাপক ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.