চারদিক-ও বন্ধু হে... by শারমিন নাহার

সূর্য সবে অস্তাচলে গেছে। ইফতারের আয়োজন চলছে। সবাই ব্যস্ত ভঙ্গিতে ইফতারি কিনে ঠিক জায়গা খুঁজছে বসার জন্য। এরই মধ্যে টিএসসির রাজু ভাস্কর্য ঘেঁষে ছোট্ট একটা ছেলে হেঁটে এল। ম্লান তার মুখ আর চোখ। নাম জিজ্ঞেস করতেই জানা যায়, নাম তার আশিক। আশিককে ইফতার করতে বললেও সে করল না।


সবার কাছ থেকে যৎসামান্য যেটুকু ইফতারি সে পাবে, তা নিয়েই বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাবে।
ছোট্ট টোকাই আশিকের কাছে কাছের মানুষ তার বন্ধু, যার সঙ্গে নিজের অপ্রতুল খাবার ভাগাভাগি করতে হয়। বন্ধুত্ব আসলে এমনই। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে বন্ধু দিবস নিয়ে। ‘বন্ধু’ শব্দটা খুব ছোট, তবে এর ব্যাপ্তি যে কতটা, তা নিশ্চয়ই আপনি বুঝবেন, যদি আপনার তেমন একজন বন্ধু থাকে। আশা করছি, আপনার তেমন একজন বন্ধু আছে। বন্ধু বলতেই অনেকে ভেবে বসেন একটা ছেলের সঙ্গে অন্য ছেলে কিংবা একটা মেয়ের সঙ্গে অন্য মেয়ের বন্ধুত্ব, অথবা একই ক্লাসে যারা পড়ছে। আসলেই কি তা-ই? বন্ধুত্ব কি বয়সের ঘেরাটোপে আটকে রাখা যায়? বন্ধু হলো যার সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করা যায় কিংবা যার সঙ্গ লাভে আনন্দ অনুভূত হয় এমন কিছু। হতে পারে আপনার পরিবারে কেউ কাছের বন্ধু। নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘বন্ধু হলো এমন একজন, যে অন্য বন্ধুর সরলতা, দুর্বলতাকে এককথায় মেনে নিতে পারে। ভুল হলে শুধরে দেবে, কিন্তু কখনোই দূরে ঠেলে দেবে না, বরং আগলে রাখবে বন্ধুত্বের মমতা দিয়ে।’ এই প্রজন্মের কাছে বন্ধুত্ব মানেই নির্ভরতা—এমনটা শোনা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জেবুন্নেছা ইভার মুখ থেকে।
আর তাই বন্ধুত্ব অবিনশ্বর সম্পর্কের এক নাম। পশ্চিমা বিশ্বে বন্ধু দিবসের শুরুটা অনেক আগে। ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টে এক লহমায় চলে যাই সেই সময়ে। দুই বিশ্বযুদ্ধ-মধ্যবর্তী সময়ে সহিংসতা, সংঘর্ষের বিষ যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখনই এই বিশেষ দিবসটা উঠে আসে। দিনটি পালনের প্রকৃত উদ্যোক্তা জয়েস হল, যিনি হলমার্ক কার্ডের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি প্রথম ১৯১৯ সালের আগস্ট মাসের প্রথম রোববার দিনটি পালন করেন। এরপর ১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস আগস্ট মাসের প্রথম রোববারকে জাতীয় বন্ধু দিবস ঘোষণা করে। আর এমন দিন জনপ্রিয় না হয়ে কি পারে? সারা বিশ্বের মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করে দিনটার সঙ্গে। সেই থেকে দিনটি আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে তরুণ প্রজন্মের আগ্রহের দিবস এটি। সাড়ম্বরে পালিতও হচ্ছে দিবসটি। এক বন্ধু অন্য বন্ধুর হাতে বেঁধে দিচ্ছে ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড।
তার মানে কি দিবসটি কেবলই তরুণদের জন্য? তা হবে কেন! বন্ধুত্ব সব বয়সেই থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস আনিসুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘বন্ধুত্বের প্রগাঢ়তা আছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বন্ধুত্ব হয়, তা বোধ হয় চলে নদীর অববাহিকার মতো।’ দার্শনিকেরাও ভূরি ভূরি কথা বলেছেন বন্ধুত্ব নিয়ে। অ্যারিস্টটল বলেন, ‘বন্ধুত্ব যেন দুই দেহে একই আত্মা।’ জর্জ হার্ভার্ট বন্ধুকে বলেছেন ‘সর্বোৎকৃষ্ট আয়না’—অর্থাৎ এই আয়নায় পুরো অবয়বকে দেখে নেওয়া যাবে বারবার। আর এই দেখে নেওয়া কেবল বাহ্যিকভাবেই দেখা নয়, বরং ভেতরকে দেখা আর নিজেকে শুদ্ধ সত্তায় উত্তরণ ঘটানো।
অবশ্য বন্ধুর কথা বললে ভালুকের গল্পটাও বোধ হয় মনে পড়ে। কীভাবে এক বন্ধুকে বিপদের মুখে ফেলে চলে যায় অন্য বন্ধু। তবে এমন অপ্রীতিকর ঘটনার চেয়ে ঢের ভালো উদাহরণ আছে।
শরৎ-সাহিত্যের শ্রীকান্তের কথা কি মনে আছে? ‘আমার এই ভবঘুরে জীবনের অপরাহ্ন বেলায় ইহার একটা অধ্যায় বলিতে বসিয়া আর কত না কথা মনে পড়িতেছে।’ স্বয়ং শ্রীকান্তের উক্তি। যেখানে শ্রীকান্তের চরিত্র গঠনে বন্ধু ইন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল অসামান্য।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের আমার বন্ধু রাশেদ নিশ্চয়ই পড়া হয়েছে কিংবা রুপালি পর্দায় দেখা। বন্ধু রাশেদ অন্য বন্ধুদের মনন তৈরিতে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিংবা দীপু নাম্বার টু উপন্যাসে দীপু আর তারেকের বন্ধুত্ব কি ভোলা যায়?
বন্ধু দিবসে সেই বন্ধুদের আবার কাছে টানি, যে বন্ধু অন্য বন্ধুর জন্য সব বাধা অতিক্রম করতে পিছপা হয় না; বন্ধুর জন্য করতে পারে ত্যাগ; অকুণ্ঠচিত্তে ভালোবাসার বাহুডোরে বাঁধে অন্য বন্ধুকে; সেই বন্ধুদের জন্য উৎসর্গ করা হোক এই দিন। বলা হোক—বন্ধু, তোমার জন্য রইল অকৃত্রিম ভালোবাসা।
শারমিন নাহার

No comments

Powered by Blogger.