জন্মদিনে কথোপকথন by জোবাইদা নাসরীন

ফুলদানিতে রাখা কয়েক রঙা অর্কিডগুলো কানাকানি করছে, অফিসে রাখা কম্পিউটারে মৃদুস্বরে চলছে জাকির হোসেনের তবলা, রুমে এক অসাধারণ নীরবতা, রুমজুড়েই আছে এক ধরনের মায়ার আবেশ। আর সেখানে বসে খুব নিবিড় মনে সহকর্মীর লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন তিনি।


হঠাৎ দেখা যেত ঘনিষ্ঠজনদের দেখা পেলেই অবসরকে তালুবন্দি করে, সেই সঙ্গকে প্রাণ দিতে কখনও বানাচ্ছেন কফি। পরম যত্নে। মাঝে মাঝে সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ-হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠতেন। নিজে কথা বলতেন অত্যন্ত ধীর লয়ে, কিন্তু ভঙ্গি অত্যন্ত ঋজু, সঙ্গে অতি চেনা প্রখর ব্যক্তিত্ব। বেশিরভাগ সময়ই মনোযোগ-শ্রোতা, যা অতি দুর্লভ মানুষের চরিত্রে। চলনে-বলনে-কথনে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিলেন তিনি। এই চিরচেনা দৃশ্য আজ নেই, তবুও স্মৃতির উঁকি বেশ শব্দ করেই জানান দেয় প্রিয়জনের অস্তিত্ব। আজও প্রকৃতি জুড়ে অর্কিড ফোটে নিত্য, হাতে লাগানো বেলি ফুলের মৌ মৌ ঘ্রাণে মন মাতে, সবই যার যার নিয়মে বাজে, সাজে কিন্তু তিনিই আজ নেই। আজ ৩ আগস্ট। সেই ঈর্ষণীয় চরিত্রের মানুষটির জন্মদিন। কোলভরা পলাশ আর কোঁচভরা শিউলি ফুল দিয়েই জানাতে চাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা। সহসাই স্বপ্নভাষী, কিন্তু অনেক বেশি প্রাঞ্জল, ধাক্কা খেয়ে অনেকটাই অন্যের সঙ্গে বয়সের ব্যবধান কমিয়ে দিতেন। অসমবয়সীরা সংকোচ ঝেড়ে উঠে সহজেই ঘনিষ্ঠ হয়ে যেতেন। ভালোবাসতেন জীবনকে, প্রকৃতিকে। আর ভালোবেসেছেন দেশকে। আজীবন ভালোবাসায় আগলে রেখেছেন 'সংবাদ' পত্রিকাটিকে। 'সুখে-দুঃখে থেকেছেন এর সঙ্গে। এর আগে 'একতা'র সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আত্মীয়তা চিরস্থায়ী হয়নি। এক জীবনে অমরত্বের সুধা তিনি পান করেননি, করতেও চাননি। খ্যতির পিছে ছোটেননি কখনও। কিন্তু তার কাজ, আদর্শ, ধীশক্তি, তীক্ষষ্ট বিশ্লেষণ শক্তি, সাহসিকতা তাকে দিয়েছে অমরত্বের জমিন। আর সেই জমিনেই নতুন আবাস তার। জমিনের অধিকার নিয়েই এই পৃথিবীতে এসেছিলেন আরও ৭১ বছর আগে। আজ তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন।
মাত্র ৮০০ স্কয়ারফিটের ছোট্ট বাসাটিতেই জীবনের আয়োজনকে সীমাবদ্ধ করতে চেয়েছেন এবং পেরেছেন। বলতেন, সকালে পাখির ডাক, সবুজ গাছ আর এই ফুলের সুবাসমাখা জীবন কোথায় গেলে পাব? পরিমিতিবোধ দিয়েই জীবনকে মোড়াতে চেয়েছেন। পরনে সবসময় সাধারণ কাপড় কিন্তু সেগুলো মাথা থেকে পা পর্যন্ত টিপটপ, পরিষ্কার এবং ইস্ত্রি করা। কোথাও কোনো ফাঁক নেই। জীবনের কাছে জীবনের মানে তৈরি করেছেন। প্রগতির মগজে যে সুবিধার বসবাস সেটিকে আশকারা দেননি, আলিঙ্গনও করেননি। কাঙালিপনা, খ্যাতি, যশ, অর্থ এগুলোর সঙ্গে চিরদিনের শত্রুতা করেছেন। কিন্তু অন্যকে ছড়িয়েছেন আলো, আজীবন জ্বলজ্বল করা আলো। ভিন্ন মতের সঙ্গে সংঘাত নয় কিংবা ভিন্ন মতকে খারিজ করা নয় বরং তাকে নিয়েই সহাবস্থান করার আদর্শের জন্যই তিনি লড়েছেন। মাথা উঁচু করেই এগিয়ে গিয়েছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে, সমাজে নারী-পুরুষের সমতার বারতা বয়ে। আজ দুনিয়াকে স্বাগত জানানোর দিন।
মানুষের ছোটবেলা থেকেই দাঁড়ানোর জায়গা দরকার। সেই জায়গা মাটি নয়, সেই জায়গা আদর্শ। বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের বুক টানটান করে দাঁড়ানোর একটি জায়গা 'খেলাঘর', আর সেটিরও খুঁটি ছিলেন তিনি। আজ প্রায় পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে টিকে থাকা সংগঠনটির শিশু-কিশোররা তাদের এই ভালোবাসার 'ভাইয়াকে' তাদের মনে গেঁথে নিয়েছে। তাদের মনেও তিনি বসবাস করছেন যুগ যুগ ধরে। আর অমরত্ব! এমনিভাবে তার কাছে ছুটে ছুটে এসেছে। আবার তার পুনর্বার ফিরে আসার দিন। জন্মান্তরের জন্মদিন।
জীবনের একটি বড় সময় কেটেছে বাম রাজনীতির দুনিয়ায়। সমতার সমাজের স্বপ্নে। মাঝে মুক্তিযুদ্ধ। জীবনের সবচেয়ে উত্তাল, কষ্টের এবং হীরণ্ময় সময়। সেখানেও সঁপেছেন নিজেকে, কোনো ধরনের কৃপণতা না দেখিয়ে। সেই সময়ে বের হওয়া 'মুক্তিযুদ্ধ' পত্রিকাটির স্রষ্টা। পরবর্তী সময়ে কিছুটা দূরে সরেছেন বটে কিন্তু একবারেই বেরিয়ে যাননি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ভূমিকায় ছিলেন। বিশেষ করে ২০০৭-২০০৮ (মৃত্যুর আগ পর্যন্ত) বাংলাদেশের রাজনৈতিক দুর্যোগের সময়েও সঠিক ভূমিকা রেখেছেন। আজ প্রকৃতিকে ভালোবাসার দিন।
এতক্ষণ আমি যার কথা বললাম তিনি আমার ঘনিষ্ঠজন, আমার নির্ভরতার মানুষ, আবদার-আহ্লাদের জায়গা, আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করার আশ্রয়, অকারণে হাসি-কান্নার উৎস, হোঁচট খেয়ে আঁকড়ে ধরা অবলম্বন. আর হাজারও উচ্ছলতার ভূমি। আমার মতো আরও অনেকের কাছে তিনি অনেক কিছু। তিনি বাংলাদেশের প্রাচীনতম প্রগতিশীল পত্রিকা 'সংবাদ' সম্পাদক বজলুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা। প্রাচীনতম এবং দেশের বৃহত্তম শিশু সংগঠন খেলাঘরের সভাপতি, যুক্তিবাদী ও মুক্তচিন্তার অধিকারী কলামিস্ট। এ দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসের তিনি একজন ধীমান ব্যক্তিত্ব। ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ছিন্ন করেন এই পৃথিবীর সঙ্গে তার সব ভালোবাসার লেনদেন। কিন্তু এই লেনদেন যে ছিন্ন হওয়ার নয়, কারণ তার মৃত্যু নেই। তিনি আমার কাছে, আমাদের কাছে, প্রিয়জনের কাছে বসে থাকেন, পাশে থাকেন, কাছে থাকেন আর থাকেন আমাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে। জন্মদিনের অনেক ভালোবাসা।
শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় zobaidanasreen@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.