বাঘা তেঁতুল-ইফতারের ফজিলত by সৈয়দ আবুল মকসুদ

সিয়াম সাধনা এমন একটি ধর্মীয় বিধান, যা প্রত্যেক সুস্থ মুসলমান নরনারীর জন্য ফরজ বা অবশ্যপালনীয়। ভোরের আলো দেখা দেওয়ার সময় থেকে সূর্য ওঠা পর্যন্ত পানাহার ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতা থেকে বিরত থাকাই সিয়াম সাধনা। সুলতানি ও মোগল আমলে রাজভাষা ছিল ফারসি। তাই সিয়াম সাধনাকে আমরা বলি রোজা।


কাম, ক্রোধ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, মোহ, লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে, পানাহার ও পাপাচার থেকে বিরত থেকে, সংযমী চরিত্র গঠন করার সাধনাই সিয়াম। তবে কোনো কোনো সমাজে সিয়ামের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইফতার।
রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তনের আগেও এ ভূখণ্ডে ইসলাম ছিল। নূরুল আমিন, এ কে ফজলুল হক, আতাউর রহমান খান, আবদুল মোনায়েম খানদের সরকার ছিল স্বাধীনতার আগে। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের সরকার ছিল ১০ বছর। ইফতারের মহো ৎ সব তখন ছিল না। ‘ইফতার অনুষ্ঠানটি রাজনীতিবিদদের মিলনমেলা’য় পরিণতি হওয়ার প্রয়োজন তখন দেখা দেয়নি।
চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে বাংলার মাটিতে রোজাদারদের ইফতারের উপকরণও ছিল খুবই মামুলি। কাগজি লেবুর শরবত, আদা-কাঁচা ছোলা, ভুনা ছোলা, দই-চিড়া, কিছু মৌসুমি ফল। সেকালে কোনো রোজাদারই এমন কিছু খেতেন না, যাতে চুকা ঢেঁকুর ওঠে অথবা প্রবল বায়ুবেগ হয়।
আজ বঙ্গীয় মুসলমানের ইফতারের উপকরণ হিসেবে যোগ হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুপাক খাদ্যসমূহ। পাকিস্তানের কুস্তিগির গামা ও আসলাম পালোয়ান প্রতিদিন যতটা না খেতেন, আজ এ শ্রেণীর ভাগ্যবান রোজাদার দিনান্তে তার দ্বিগুণ খাচ্ছেন।
আজকাল ইফতারির টেবিলে আয়ুর্বেদি ও হেকিমি হজমি বড়ি অবধারিতভাবে রাখা থাকে। ইফতারের পরে দুটো গিলে নেন রোজাদার। সম্ভাব্য পেটের গোলযোগ ঠেকাতে অগ্রিম দুটো ট্যাবলেটও খেয়ে নেন কেউ সেহিরর সময়। গতবার বঙ্গভবন থেকে ইফতার করে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় আমার পরিচিত এক উচ্চপদস্থ শিক্ষাবিদ বললেন, খারাপ লাগছে। বললাম, সোহরাওয়ার্দী বা অন্য কোনো হাসপাতালে যাওয়া লাগবে কি? বললেন, সোহরাওয়ার্দীতে না, টয়লেটে। তিনি দ্রুতবেগে আবার ঢুকে গেলেন বঙ্গভবনে।
ইফতারের ধর্মীয় তা ৎ পর্য কী, তা আলেম-ওলামারা বলতে পারবেন। আমি দেখছি তার অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বা গণতান্ত্রিক তা ৎ পর্য। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক তা ৎ পর্যের কথা ব্যবসায়ী নেতারা ভালো জানেন। তাঁদের দুঃখ শুধু একটাই—সারা বছরে রোজা শুধু এক মাস কেন? শাবান, শাওয়াল, জিলকদ ও রবিউল সানি মাসেও যদি রমজানের মতো সিয়াম সাধনার বিধান থাকত! আড়াই শ টাকা কেজি চিনি খাওয়াতে পারতাম।
ইফতারের সামাজিক তা ৎ পর্য কোনো কোনো উন্নতিকামী চাকরিজীবী ও মেয়ের বাবারা ভালো জানেন। বসকে ইফতার না করালে এক বিপদ, বেয়াই-বেয়ানকে বত্রিশ পদ দিয়ে ইফতার না করালে মেয়ের কপালে কী আছে, তা বলা কঠিন। বাংলার মাটিতে ছেলের বাবারা বাদশা। বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে পাওয়ার জন্য উপলক্ষের শেষ নেই। তবে মামুলি পিঁয়াজু, বেগুনি আর ছোলা ভুনায় মন ভরে না। শুধু হালিমের হাঁড়িতেও মন উঠবে না। সেকেলে কাচ্চি বিরিয়ানি থাকতেই হবে। আধুনিক বিশ্বায়নী আইটেমও চাই। যেমন—পি ৎ জা, মাটন লেগ (খাসির আস্ত পা), কাবাব কারি, চিকেন রোস্ট, চিকেন থাই পিস, চিকেন ফ্রাই, খাসির মগজের স্যান্ডউইচ এবং আরও এমন সব নামের খাদ্য, যা আমাদের চৌদ্দপুরুষ শোনেনি। ইনসুলিন, হার্টের ওষুধ ও এসব আইটেম একসঙ্গে চলে।
কয়েক মাস যাব ৎ বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। আইয়ুব খানের গণতন্ত্র ছিল ‘মৌলিক গণতন্ত্র’। আওয়ামী লীগের সমাজতন্ত্র হলো ‘মৌলিক সমাজতন্ত্র’। মৌলিক সমাজতন্ত্রে মিন্স অব প্রোডাকশন বা উ ৎ পাদনের উ ৎ স মিল-ফ্যাক্টরি, ব্যবসা-বাণিজ্য রাষ্ট্রের হাতে নয়, ব্যবসায়ীদের হাতে থাকে। রাষ্ট্র আঙুল চোষে। তাই রোজার আগে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের গুদামে চিনি মজুদ থাকলেও রাষ্ট্রের কিছুই করার থাকে না। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সিয়াম সাধনার এটি অর্থনৈতিক ফজিলত।
ইফতারের রাজনৈতিক তা ৎ পর্য বড় দলগুলোর নেতাদের চেয়ে বেশি কেউ বোঝেন না। পয়লা রমজান থেকেই তা শুরু হয়েছে। ইফতারের গণতান্ত্রিক তা ৎ পর্য ও নির্বাচনী ফজিলত নিয়ে আমি যদি লিখতে শুরু করি রুশো, ভলতেয়ার ও হ্যারল্ড লাসকি হেরে যাবেন। আমাদের রাষ্ট্র অন্য রকম, গণতন্ত্র আলাদা কিসিমের, আমাদের নেতাদের নীতিও সম্পূর্ণ ভিন্ন। সবকিছুতেই আমরা আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে শিখেছি। কি সিয়াম সাধনা, কি কোনো কবির সার্ধশততম বর্ষ, কি সমাজতন্ত্র, কি সেক্যুলারিজম—সবই কাজে লাগাতে পারি। ব্যক্তি ভণ্ড-প্রতারক হতে পারে, কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে পরিণত হয়েছি কালেকটিভ ফ্রড বা সমষ্টিগত প্রতারকে।
রাষ্ট্র অনেক পরের ব্যাপার। তার আগে গঠিত হয় সমাজ ও জাতি। উন্নত সমাজের একটি নৈতিক ভিত্তি থাকে, উন্নত জাতি দাঁড়িয়ে থাকে একটি দার্শনিক তক্তার ওপর। বাঙালি জাতির নৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি না থাকায় ধর্ম ও রাজনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও অনাচারে পরিণত হয়েছে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.