সবচেয়ে ভালোবাসো মাতৃভাষাকে by আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) মানুষ তো তোমাকে নিয়ে হাসবে। সব জাতি কি একভাবে কাঁদে? একজন আফ্রিকান- বিশাল তার কান্না, আর বাঙালি কাঁদে কঁকিয়ে কঁকিয়ে- এসব শিখতে হবে না? জাতীয় জীবনের যে অঙ্গনেই তুমি নেতৃত্ব দিতে চাও, এই জাতিকে তোমার জানতে হবে, মানুষকে বুঝতে হবে, এর গাছপালা, পশুপাখি, নদ-নদী, ঐতিহ্য-কৃষ্টি- সব কিছুকে


তোমার চিনতে-জানতে হবে, এই দেশের ধুলোর নিচে আমাদের পিতৃ-পিতামহের যে যুগ-যুগের পায়ের চিহ্ন রয়েছে, তার আগাগোড়া ইতিহাস খোলা বইয়ের মতো তোমাকে বুঝতে হবে। তবেই না তুমি এ দেশের সত্যিকার সন্তান হবে। এ দেশের নেতা বা বড় মানুষ হবে। তাই কেবল বাংলা ভাষা নয়, আমাদের জাতির ইতিহাস, ভূগোল, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি- সব জানা-বোঝা তোমার জরুরি। তবে যত যা-ই জান, সবচেয়ে ভালো করে জানতে হবে মাতৃভাষাকে। এর কারণ বোঝা খুবই সোজা। আমাদের জাতি হাজার হাজার বছর ধরে যা কিছু ভেবেছে, অনুভব করেছে, স্বপ্ন দেখেছে, যা কিছু চিন্তা বা উপলব্ধি করেছে, যত অসংখ্য সুখ-দুঃখ, আলো-অন্ধকারের ভেতর দিয়ে পথ হেঁটেছে, এই ভাষা সে সব কিছুকে বুকে করে রেখেছে। এই জাতির যত আলো, যত মেধা, দীপ্তি আর স্বপ্ন- সব রয়েছে এই ভাষার মধ্যে। সুতরাং তুমি যা-ই হতে চাও এই ভাষা ভালোভাবে না জানলে তুমি এগোতেই পারবে না। যদি শুধু একটা তুচ্ছ চাকরি করে একটা ছোট্ট অন্ধকার কুঠুরির মধ্যে নামহীন-পরিচয়হীনভাবে জীবন শেষ করতে চাও, তাহলে এসব না হলেও চলবে। কিন্তু এমন তুচ্ছ মানুষ হয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে কে চায়? এতে গৌরব কোথায়? মানুষ তো সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। এত ছোট্ট হয়ে কোনোমতে টিকে থাকলে কি তার চলে! শেখ সাদী লিখেছেন, 'এক জায়নামাজে ৯ জন সুফীর জায়গা হয়; কিন্তু এক রাজ্যে দুই জন রাজার জায়গা হয় না।' তোমাকে তো হতে হবে সেই রাজা। পৃথিবীর অধীশ্বর। এত অল্প দিয়ে তোমার চলবে কী করে! যদি পৃথিবীতে বড় কিছু করতে চাও, বড় নেতৃত্ব দিতে চাও, বড় ডাক্তার, বড় আমলা, বড় বিজ্ঞানী হতে চাও, বিখ্যাত বা বিশ্বখ্যাত মানুষ হতে চাও, জাতির জীবনে অমরত্ব চাও, বাংলা ভাষা তোমাকে শিখতেই হবে। আগেই তো বলেছি, উচ্চারণ খারাপ হলে ভালো গায়কও কত হাস্যকর হয়ে যেতে পারে! এই তো সেদিন একটা গান শুনলাম- এক গায়ক গাইছে : 'টুমি খি সাড়া দিবে' (সবার হাসি); দেখ তোমরা যেমন হাসলে, সবাই এ গান শুনে তেমন হাসাহাসি করে। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, ওই উচ্চারণে প্রেমিক ১০০ বছর গান গাইলেও কোনো প্রেমিকা তার ডাকে সাড়া দেবে না। নিজের ভাষা না জানার এই হলো শাস্তি। তুমি খ্যাতি পাবে না, সম্মান পাবে না, উপেক্ষিত-হাস্যকর হয়ে পড়ে থাকবে। সারা জাতি তোমাকে তাচ্ছিল্য আর উপেক্ষা করে একসময় ভুলে যাবে।


তোমাদের স্কুল ইংরেজি মিডিয়াম, তোমরা এখানে ইংরেজি শিখছ, এতে কোনো অসুবিধা নেই। আজকের পৃথিবীতে ইংরেজি ভাষার খুবই গুরুত্ব। এ শুধু আমাদের দেশের জন্য নয়, সব দেশের জন্য। চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে ভাব বিনিময়- এসব ব্যাপারের জন্য ইংরেজি আজ পৃথিবীর এক নম্বর ভাষা হয়ে উঠেছে। সুতরাং সব জাতির মতো ইংরেজি ভাষা আমাদেরও শিখতেই হবে। কিন্তু পৃথিবীর সব জাতি ইংরেজিকে কি শেখে প্রথম ভাষা হিসেবে না দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে? তোমরা জান কি না জানি না, সব উন্নত দেশেই ইংরেজি শেখানো হয় দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে। কিন্তু প্রথম ভাষা হিসেবে শেখানো হয় মাতৃভাষাকে। তাহলে আমাদেরও প্রথম ভাষা হিসেবে শেখানো উচিত কোন ভাষা? বাংলা ভাষা, তাই না? সব দেশের মানুষই মনে করে, প্রথম ভাষা হিসেবে মাতৃভাষা শেখানো উচিত, আর সেই সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের উচ্চতর বিকাশের জন্য দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে পৃথিবীর একটি সমৃদ্ধ ভাষা শেখানো উচিত। কোনো কোনো দেশে একটি তৃতীয় ভাষা শেখাও বাধ্যতামূলক। যেসব দেশে ইংরেজি মাতৃভাষা, সেসব দেশেও দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ফরাসি, স্প্যানিশ বা জাপানি ভাষা শেখানো হয়। অনেকখানে তৃতীয় ভাষা হিসেবে শেখানো হয় অন্য একটি সমৃদ্ধ ভাষা। সব দেশে যদি এমনটাই হয়, আমাদের দেশের প্রথম ভাষা কী হওয়া উচিত? (ছাত্ররা : মাতৃভাষা।) আগেই তো বলেছি, আমাদের দুই পায়ের একটা পায়ে জোর একটু বেশি, একটা পায়ে একটু কম। তাহলে এই বেশি জোরটা দিতে হবে কোন ভাষাকে? (ছাত্রছাত্রীরা : মাতৃভাষাকে)। তা-ই যদি হয়, তাহলে চলাফেরায় ভারসাম্য রাখতে আমাদের সত্যিকার সুবিধাই হয়ে যাবে।
আমেরিকানরা তাদের ছেলেমেয়েদের কী হিসেবে গড়ে তুলতে চায়? পাকিস্তানি হিসেবে? (সমস্বরে : না) জাপানিরা কি হিসেবে তাদের ছেলেমেয়েদের গড়ে তুলতে চায়? ইরাকি হিসেবে? (সমস্বরে : না) ফরাসিরা কী হিসেবে তাদের ছেলেমেয়েদের গড়ে তুলতে চায়? জার্মান হিসেবে? (সমস্বরে : না)।
আমেরিকানরা নিশ্চয়ই চায় তাদের সন্তানরা আমেরিকান হয়ে গড়ে উঠুক, নিজেদের জাতিকে একটি গর্বিত জাতি হিসেবে পৃথিবীর ওপর প্রতিষ্ঠিত করুক। একইভাবে ফরাসি, জার্মান বা জাপানিরা নিশ্চয়ই ভাবে, তাদের সন্তানরা বেড়ে উঠবে একেকজন গর্বিত ফরাসি, জার্মান বা জাপানি হিসেবে।
এখন বলো, আমরা কী চাইব? আমাদের দেশের একটি ছেলে বা একটি মেয়ে কী হয়ে গড়ে উঠবে? অন্য দেশের মানুষ হয়ে, না বাঙালি হয়ে? (সমস্বরে : বাঙালি হয়ে)। দুটো পায়ের মধ্যে বেশি জোর কোনটাতে দেবে ইংল্যান্ড বল, ফ্রান্স বল, জার্মানি বল, ইতালি বল, জাপান বল, চীন বল- তারা কোন ভাষার ওপর বেশি জোর দেয়? মাতৃভাষার না ইংরেজি ভাষার ওপর? সমস্বরে : মাতৃভাষার ওপর। তারা ইংরেজি ভাষা খুবই শেখে, কিন্তু বেশি জোর দেয় মাতৃভাষার ওপর। তোমরা গিয়ে দেখো ওসব দেশে। রাস্তাঘাটে, অফিসে, স্কুল-কলেজে, হাসপাতালে, হাট-বাজারে, বিনোদনকেন্দ্রে- সবখানেই মাতৃভাষা। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যে আর আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জায়গায় শুধু ইংরেজি। আমরাও জোর দেব ইংরেজির ওপর, কিন্তু আরো বেশি দেব কোন ভাষার ওপর? মাতৃভাষার ওপর, তাই না? না হলে দুই পায়ের ভারসাম্য রাখব কী করে। এক পায়ে নাচতে গেলে তো তিড়িং করে আছাড় খেয়ে পড়ে যাব।
(চলবে)

No comments

Powered by Blogger.