মহাজোটে অসন্তোষ-শরিকদের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে হবে

আওয়ামী লীগ তার ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং 'একলা চলো' নীতির কারণে ক্রমেই মিত্রহীন হয়ে পড়ছে। অন্তত রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তা-ই মনে করছেন। নির্বাচনী মহাজোট এখন কার্যত অস্তিত্বহীন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ইতিমধ্যেই আগামী নির্বাচন এককভাবে করার ঘোষণা দিয়েছেন।


আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বাকি শরিকদের মধ্যেও নানা কারণে অসন্তোষ বাড়ছে। তারা ইতিমধ্যে আলাদা বৈঠকও করেছে; এবং অন্তর্বর্তী সরকারসহ বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে গণমাধ্যমে তাদের ভিন্নমত তুলে ধরেছে। এমনকি বাম দলগুলোর পক্ষ থেকে স্পষ্টতই অভিযোগ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনের আগে ঘোষিত দিন বদলের সনদ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এ অবস্থায় কেবল ধীর লয়ে চলা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি এই ঐক্যকে কতটা ধরে রাখতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে।
বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের বিপুল বিজয়ের পর কার্যত তা কেবল আওয়ামী লীগের বিজয়ে পরিণত হয়েছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনেক ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম দিয়েছে। গত তিন বছরে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী মিত্র জাতীয় পার্টি বা ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই গুরুত্বপূর্ণ বহু বিষয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে- এমন অভিযোগ মিত্রদের পক্ষ থেকেই করা হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি-লুটপাট, দখলবাজি-চাঁদাবাজি বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। একতরফাভাবে খুনসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকা দলীয় লোকজনের মামলা প্রত্যাহার, খুনিদের দণ্ড মওকুফ, অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং রাস্তাঘাটের বেহাল দশাসহ জনজীবনের নানা সমস্যা বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি, মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের লাগামহীন উক্তি এবং দলগত একগুঁয়েমির কারণে মানুষ সরকারের ওপর ক্রমেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে। সরকার ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। মহাজোট কার্যকর না থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের নানামুখী ব্যর্থতার দায়ভার শরিকদেরও নিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় এসব অনাচারের প্রতিবাদ করা কিংবা তার বিরুদ্ধে সরব হওয়া ছাড়া তাদের সামনে কোনো পথ খোলা নেই।
সর্বোচ্চ আদালত আরো দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে মত দিলেও পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট এ নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলছে। এ অবস্থায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের লক্ষ্যে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে বসার জন্য সরকারের প্রতি বিভিন্ন মহল থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সংলাপে বসার ব্যাপারে এক ধরনের অনীহা প্রকাশ করে চলেছে। অথচ এ বিষয়ে এক ধরনের জাতীয় ঐক্য প্রায় হয়েই আছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া প্রায় সব দলই নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছে। তাই ১৪ দলের বাকি শরিকরা এখনই এ ব্যাপারে সংলাপ শুরু করার যে দাবি জানিয়েছে, তা অত্যন্ত যুক্তিসংগত। তারা এখনো চাইছে, আওয়ামী নেতৃত্বের বোধোদয় ঘটুক এবং একগুঁয়েমি ছেড়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল হোক।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও গণতন্ত্রের চর্চা থেকে অনেক দূরে। বিরোধী দলের সঙ্গে তো দূরের কথা, নিজ মিত্রদের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ-আলোচনা করতেও সরকারি দলের এই যে অনীহা, গণতন্ত্রের চর্চা থেকে তা দূরে থাকারই প্রমাণ। এই আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে আওয়ামী লীগকে বেরিয়ে আসতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.