একজন বইয়ের পোকার বইময় জীবন

আমাদের গল্পের নায়ক পোকা তখন হাফ প্যান্ট পরে। পড়ে গল্পের বইও। শুধু পড়ে বললে ভুল হয়, ‘গোগ্রাসে গেলে’ বললে মনে হয় ব্যাপারটার ধারেকাছে যাওয়া যায়। সেই ছেলেবেলা থেকেই শুরু তাঁর বইময় জীবন। ছেলেবেলায় কে যেন তাঁকে একটা শিক্ষামূলক বই উপহার দিল একদিন; নাম মিলেমিশে করি কাজ।


বইটা খুলে কেবল এক লাইন পড়তেই ভাইবোনেরা এসে সেটা নিয়ে শুরু করল তুমুল কাড়াকাড়ি। মিনিট পাঁচেক বাদে সবাই আবিষ্কার করল, বইটা আর নেই! মিলেমিশে কাজ করলে কী হয় আর না হয়, পোকা সেটা টের পেল সেদিনই!

রাগে-দুঃখে তার পরদিন থেকে লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নিল পোকা। বোকা হলো তখন, যখন দেখল লাইব্রেরির বইয়ের তাকের সবচেয়ে ওপরের তাকে লেখা ‘বিরল বই’। নাগালের বাইরে থাকা বই তো বিরলই হয়, পোকা সেটা টের পেল তখনই।

একটু বড় হলো পোকা। গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে। গণিতের প্রবলেম সলভিংয়ের বইগুলো তাঁর দারুণ প্রিয়। তবে প্রথম দিনই সে আবিষ্কার করল প্রবলেম সলভিংয়ের বইগুলো বইয়ের সেলফের একদম ওপরের তাকে রাখা। পায়ের নিচে বস্তাপচা কিছু বই জড়ো করে একটা ঢিবির মতো তৈরি করে প্রিয় বইগুলোর নাগাল পেল পোকা। লাইব্রেরিয়ান ততক্ষণে তেড়ে এসেছেন! তবে ততক্ষণে ‘প্রবলেম সলভ’ হয়ে গেছে!

প্রেমে পড়ল পোকা! একদিন সে দেখা করতে গেল মনের মানুষটির সঙ্গে। ঝাড়া পাঁচ দিন কী করবে না করবে, তার ওপর একটা অনুশীলনও করে ফেলেছে সে। তার পরও সঙ্গে রাখল ‘প্রথম দেখায় যা করবেন’ বইটি। মেয়েটির দেরি দেখে বইটা খুলে সামনে মেলে ধরল পোকা। কাল হলো সেটিই! মেয়েটি এলও, তবে পোকাকে উল্টো করে বই পড়তে দেখে দেখা না করেই ঘরের মেয়ে ফিরে গেল ঘরে!

হূদয় পুড়ে ছারখার। কী করে পোকা? কার কাছে যায়? শেষ ভরসা ওই বই! বইয়ের দোকানে গেল সে। খুঁজে খুঁজে হাতে নিল ‘স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর ১০১টি উপায়’ বইটি। বইয়ের দোকানে যে ছেলেটা বসে, পোকাকে সে খুব ভালো করে চেনে। পরিচিত গ্রাহকের হাতে ওই বইটা দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ভাইজান, শরীর কি খুব খারাপ? ঘুম হয় ঠিকমতন?’ পোকার প্রশ্ন, ‘কেন?’ ছেলেটা, দ্বিধাগ্রস্ত, ‘না, মানে, এই বই তো আপনি গত পরশু নিয়ে গেলেন!’

পোকা এই স্মৃতিশক্তি হারানোর ব্যাপারটা মানতে পারল না! মাথার ঠিক নেই তাঁর। ঘরের সব বই সের দরে বেঁচে দিল! সেই টাকা দিয়ে কিনে ফেলল একটা স্মার্ট ই-বুক রিডার। একদিন বিকেল বেলা, হঠাৎ কী হলো, পোকা ছুটল বাইরে। পাড়ার এক ইলেকট্রিশিয়ানের কাছে গিয়ে বলল, ‘ভাই, একটু সময় হবে আপনার? আমার বইয়ের লাইব্রেরিটা কেন জানি কাজ করছে না!’ ইলেকট্রিশিয়ান একটা টিভির রিমোট ঠিক করতে করতে বললেন, ‘আমি তো ভাই লাইব্রেরি সারাই না।’ পোকা নাছোড়, ‘ভাই, আমি জেনেবুঝেই আপনাকে ডাকছি। চলেন, প্লিজ।’ গাইগুই করলেও একসময় মজা দেখার জন্য ইলেকট্রিশিয়ান পোকার লাইব্রেরি, মানে বইয়ের সেলফের সামনে হাজির হলো। দেখল, নষ্ট স্মার্ট ই-বুক রিডারটি একলা পরে আছে সেখানে!

অনেক তো পড়া হলো, এবার লেখালেখি করলে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ‘জনপ্রিয় হওয়ার গোপন সূত্র’ নামের একটা বই লিখে উদাস উদাস ভাব নিয়ে বইমেলায় ঘোরাঘুরি শুরু করল পোকা সাহেব। আফসোস, ভক্তদের অটোগ্রাফ দেওয়া তো দূরের কথা, টিপসইও দিতে পারল না একটাও!

প্রকাশক ভদ্রলোক অবশ্য পোকার খুব কাছের মানুষ। তাই বইমেলা শেষে মন খারাপ করে থাকা তরুণ লেখক পোকাকে ঘুরতে নিয়ে গেলেন কক্সবাজার। ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়’—চিরাচরিত এই প্রবাদ নতুন করে লেখা হলো ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর খেপিয়া যায়’! ঝড় উঠল একটা ভয়ংকর। পরদিন একটা দ্বীপে নিজেদের আবিষ্কার করলেন তরুণ লেখক পোকা ও তাঁর প্রকাশক। তিন দিন বাদে পানিতে একটা পানির বোতল ভেসে আসতে দেখল পোকা। ‘ইয়াহু’ বলে লাফিয়ে উঠল বাচ্চাদের মতো, ‘প্রকাশক সাহেব, আমার আত্মজীবনীতে মনে করেন এই পানির বোতলের জন্য একটা আলাদা অধ্যায় থাকবে! মারমার কাটকাট বিক্রি!’

No comments

Powered by Blogger.