রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নে ডাক বিভাগের অভিনব পন্থা by এ এম এম শওকত আলী

পৃথিবীর সব দেশেই সরকার পরিচালিত ডাক বিভাগ রয়েছে। নব্বইয়ের দশকে সার্বিক বেসরকারিকরণের স্লোগানের স্রোতে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সরকারি ডাক বিভাগকে বেসরকারিকরণের কথা শোনা গিয়েছিল। ওই সময় যুক্তরাজ্যের রাজকীয় ডাক বিভাগ নামের প্রতিষ্ঠানটিরও বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব বিবেচিত হয়।


প্রস্তাবটি শেষ পর্যন্ত গৃহীত না হওয়ায় আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে ওই সময় বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিস চালু হওয়ায় বিশ্বব্যাপী সব ডাক বিভাগই চিঠিসহ অন্যান্য সামগ্রী আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশেও একই চিত্র পরিলক্ষিত হয়। ফলে আমাদের ডাক বিভাগের রাজস্ব ক্ষতি কত হয়েছে সে বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। থাকলে ভালো হতো। এর সঙ্গে বর্তমানে যোগ করা যায় সর্বাধুনিক ইলেকট্রনিক বার্তা আদান-প্রদানের ক্ষেত্র।
ইলেকট্রনিক বার্তার আদান-প্রদান প্রসারের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে ব্যয়সাপেক্ষ। কারণ এর জন্য মূলধন ব্যয় অধিকতর। প্রয়োজন ডিজিটাল টেলিফোন পদ্ধতি। আগে অ্যানালগ প্রথা চালু ছিল। নব্বইয়ের দশক থেকেই সরকারি টেলিফোন ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল লাইন স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এখন প্রায় সব জেলা-উপজেলায় এ পদ্ধতি চালু হয়েছে। তবে বার্তা আদান-প্রদানের জন্য প্রয়োজন কম্পিউটার এবং এ যন্ত্র ব্যবহারে পারদর্শী বা দক্ষ কর্মী। এ ক্ষেত্রেও বেসরকারি খাত সরকারের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। মুঠোফোনের প্রযুক্তির সঙ্গে ছোট আকারের বার্তা এখন শহরাঞ্চলে বহুল পরিচিত। মুঠোফোনের ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া এ দেশে চালু হয় আশির দশকের শেষার্ধে। বর্তমানে একাধিক বেসরকারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসায় যুক্ত। ফলে ব্যক্তিভিত্তিক কথাবার্তাসহ ছোট আকারের বার্তা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে যোগাযোগ সহজতর হয়েছে।
বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা। সরকারের রূপকল্প ২০২১ সালে এর প্রতিফলন ঘটবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে এ বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ডাক বিভাগও যে প্রশংসনীয়ভাবে এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে সাফল্য অর্জন করেছে সে বিষয়টি এখনো অনেকেরই অজানা। কারণ সরকারি পরিমণ্ডলে ডাক বিভাগ একটি প্রাচীন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এর কোনো চাকচিক্য নেই। ডাক বিভাগের বর্তমান মহাপরিচালকের ধারণা, সরকারি টেলিফোন সংস্থাকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যে গুরুত্ব ও সময় দেয় তার মাত্র দুই শতাংশ সময় ডাক বিভাগকে দিলে এ বিভাগটি আরো সক্রিয়ভাবে সেবা প্রদানে সক্ষম হতো।
এ ধারণার বশবর্তী হয়েই ডাক বিভাগ সরকার ঘোষিত রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়। এ বিভাগের বিশ্বাস, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ডাক বিভাগের সেবার মান ও মাত্রা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলেই মন্ত্রণালয়সহ সার্বিকভাবে সরকার এ বিভাগের প্রতি আকৃষ্ট হবে। বিষয়টি এখন বাস্তবতা।
বিগত দুই বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রেও এ বিভাগ উল্লেখযোগ্য আয়-উপার্জনসহ সেবার মান ও মাত্রা বৃদ্ধিতে সাফল্য অর্জন করেছে। ২০১০ সালে ডাক বিভাগ একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ বিভাগের সেবাভিত্তিক কার্যক্রমে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির প্রবর্তন করে। ডাকঘরগুলোর কাউন্টারভিত্তিক কার্যক্রমসহ অন্যান্য কার্যক্রমে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করা হয়। প্রয়োজন ছিল উপযুক্ত সফটওয়্যার। ফলে ডাক বিভাগ ও এর গ্রাহক উভয়েরই শ্রম ও সময়ের সাশ্রয় হয়। ভোগান্তি হ্রাস পায়। প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ে ৭১টি প্রধান ডাকঘর এবং ১৩টি ডাক বাছাই কেন্দ্রের কার্যক্রমে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের সূচনা হয়। এ প্রকল্পের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো একটি ওয়েববেজড সমন্বিত সফটওয়্যার। বর্তমানে সফটওয়্যারের কাজ চলছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবহারও করা হচ্ছে। প্রকল্প ব্যয় মাত্র ৫০ কোটি টাকা।
সফটওয়্যারের জন্য সরকারি টাকা ব্যয় করা হয়নি বলে জানা গেছে। সফটওয়্যার তৈরি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এক অভিনব পন্থা মহাপরিচালক গ্রহণ করেছেন। এক দিন এক যুবক তাঁর কাছে নিজের তৈরি একটি সফটওয়্যার নিয়ে হাজির হন। যুবকটির বিশ্বাস তিনি যে সফটওয়্যার তৈরি করেছেন তা ডাক বিভাগের জন্য উপযোগী। মহাপরিচালক প্রশ্ন করলেন_তিনি কেন ব্যাংকগুলোর কাছে যান না? অনেক ব্যাংকই হিসাব ব্যবস্থাপনায় অনলাইন পদ্ধতি চালু করেছে এবং এর সম্প্রসারণের জন্যও আগ্রহী। যুবকের উত্তর ছিল গিয়েছিলেন। যে ব্যাংকে গিয়েছিলেন তারা সেটা ব্যবহারও করছিল। কিন্তু এর জন্য তাঁকে কোনো মূল্য দেয়নি। সোজা কথায় প্রতারণা করেছে। মহাপরিচালকের কাছে যুবকের দাবি ছিল সামান্য একটা চাকরি। যেকোনো সরকারি দপ্তরে চাকরি দেওয়ার বিষয়টি জটিল নিয়মকানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ। এ কারণেই মহাপরিচালক যুবকটিকে যে প্রস্তাব দেন তা ছিল তাঁর সফটওয়্যার সফলভাবে এ দপ্তরেই ব্যবহার করবেন এবং তা করতে পারলে অন্য কোনো উপায়ে পারিশ্রমিক নিশ্চিত করবেন। এটাই ছিল সরকারি দপ্তরপ্রধানের অভিনব পন্থা। সফটওয়্যার ব্যবহারের বিষয়টি সফল হলো। এর মাধ্যমে এ সেবার কার্যক্রম ২০১০ সালের ২৬ মার্চ বাণিজ্যিকভাবে চালু হয়। ডাকঘরগুলোতে ইলেকট্রনিক/মোবাইল মনি-অর্ডারের সেবা চালু হয়। বর্তমানে দেশের এক হাজার ৫৫০টি বিভিন্ন শ্রেণীর ডাকঘরে এ সেবা দেওয়া হচ্ছে। এর আওতায় রয়েছে সব জেলার প্রধান ডাকঘর, উপজেলার সব ডাকঘর এবং নির্বাচিত কিছু ডাকঘর। এ সেবা জানামতে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এর প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় প্রতি মাসেই গ্রাহকের বা সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা দারুণভাবে ঊর্ধ্বমুখী। ২০১০ সালের মে মাসে যখন এ সেবা চালু করা হয় তখন জারি করা মনি-অর্ডারের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৪৩৫, টাকার পরিমাণ ছিল ৮০ লাখ ৪৮ হাজার ৪৮৯, বিলি করা মনি-অর্ডারের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৩৩৫ এবং এর টাকার পরিমাণ ছিল ৭৮ লাখ ২৬ হাজার ৪২৬। ডাক বিভাগের অর্জিত কমিশন ছিল এক লাখ ২৬ হাজার ৩৯১ টাকা। ক্রমান্বয়ে গ্রাহকের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ২০১১ সালের মার্চে জারি করা মনি-অর্ডারের সংখ্যা ছিল দুই লাখ ১০ হাজার ৩৮৪, টাকার পরিমাণ ৪২৩ কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার ৮৬১, বিলি করা মনি-অর্ডারের সংখ্যা ১১ লাখ ২৭ হাজার ২৯১, টাকার পরিমাণ ৪২১ কোটি ৯৪ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫০, অর্জিত কমিশন ছয় কোটি ৩৭ লাখ ৫৫ হাজার ১৬৭ টাকা।
প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলেও মহাপরিচালক এর ফলে সরকারি নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। কারণ সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত আইন ও বিধিতে যে পদ্ধতি অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা তিনি লঙ্ঘন করেছেন। আত্মপক্ষ সমর্থনে তাঁর জবাব ছিল এ দোষে তিনি দোষী নন। কারণ একের পর এক বেসরকারি মুঠোফোন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সরকারি পর্যায়ে এ ব্যবস্থা প্রবর্তনে আগ্রহী হলেও তাঁর যুক্তি ছিল অভিনব। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেছিলেন, এ সেবার মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপনকারী (Connectivity) প্রতিষ্ঠান অচিরেই বিপুল অর্থ আয় করতে সক্ষম। এ ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহারের পক্ষে প্রথমে মত দিয়েছিলেন।
ওই যুবকের উদ্ভাবিত সফটওয়্যার ব্যবহার করার সিদ্ধান্তে ডাক বিভাগ অবিচল ছিল। শেষ পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠান বিনা মূল্যে যোগাযোগ (Connectivity) সুবিধা প্রদানে রাজি হয়। প্রতিষ্ঠানটি এ বিষয়ে সম্মতি প্রদানের পরই ডাক বিভাগ আর একটি শর্ত প্রদান করে। শর্তটি ছিল, যে যুবকটি সফটওয়্যার তৈরি করেছেন তাঁকেই এটা সফলভাবে চালু করার জন্য ব্যবহার করতে হবে এবং পারিশ্রমিক বাবদ ওই প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ টাকা মাসিক বেতন দিতে হবে। প্রতিষ্ঠানটি রাজি হয়ে শর্ত দেয়, যুবকটি তাদের প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করবেন। ডাক বিভাগ তা গ্রহণ করে। কয়েক দিন পরই প্রতিষ্ঠানটি প্রস্তাব দেয়, যুবক ও তাঁর সহযোগী কোনো নিয়মকানুন মানতে আগ্রহী নন বিধায় তাঁরা যেন ডাক বিভাগেই কাজ করে। এ প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করা হয়। সহযোগীসহ যুবকটিরও কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয়।
সম্প্রতি ইউনিভার্সাল পোস্টাল অর্গানাইজেশনের একটি সভায় গৃহীত উদ্যোগের বিস্তারিত বিবরণ মহাপরিচালক উপস্থাপন করেন। বিশ্বের উন্নয়নশীল কিছু দেশ এ পদ্ধতি প্রবর্তনে আগ্রহী হয়। মহাপরিচালক তাঁদের বলেন, সফটওয়্যারটি তিনি বিনা মূল্যে প্রদান করবেন, তবে একটি শর্তে। শর্তটি হলো, ওই যুবক ও তাঁর সহযোগী সংশ্লিষ্ট দেশে এ সফটওয়্যার চালু করবেন দুই বছরের মধ্যে এবং তাঁর যাবতীয় পারিশ্রমিকসহ ও অন্যান্য ব্যয় ওই দেশকে বহন করতে হবে। সফটওয়্যার ব্যবহারে ইচ্ছুক দেশটি এ প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। সম্ভবত ওই যুবক ও তাঁর সহযোগী এখন ওই দেশটিতে অন্তত দুই বছরের জন্য কাজ করবেন।
ডাক বিভাগ গ্রামাঞ্চলের ডাকঘরগুলোতে মোবাইল ফোনভিত্তিক সেবা চালু করেছে। আট হাজার ২১৭টি ডাকঘর বর্তমানে এ কাজ করছে। এসব ডাকঘরে কোনো স্থায়ী কর্মীর ব্যবস্থা নেই। সব সরকারই ব্যয় সংকোচন নীতির জন্য কোনো স্থায়ী কর্মীর সংস্থানে সম্মতি প্রদান করে না। এদের পদবি হলো অবিভাগীয় পোস্টমাস্টার, অবিভাগীয় ডাকপিয়ন ও অবিভাগীয় রানার। এদের কোনো বেতন নেই। সামান্য কিছু সম্মানী রয়েছে। মোবাইল ফোনসেবার জন্য অর্জিত কমিশনের একটি অংশ এদের দেওয়ার জন্য ডাক বিভাগের প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে প্রায় দুই বছর সময় লাগে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ব্যয় সংকোচন নীতির ফলে গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মান এত দিন বাধাগ্রস্ত ছিল। এখন কিছুটা হলেও তা দূর হলো।
সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনো সময়ই অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না। কারণ আইনকানুন বাধা দেয়। আইনকানুন অমান্য করলে বিভাগীয় মামলার মাধ্যমে কর্মকর্তাদের দণ্ডিত করা হয়। তবে বলা যায়, আইনকানুনই একমাত্র বাধা নয়। সবচেয়ে বড় বাধা দৃষ্টিভঙ্গি।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.