গণপরিবহন-জনপ্রতিরোধের বার্তা ও নিস্পৃহ সরকার by আসজাদুল কিবরিয়া

গণমানুষের যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন তারা মরিয়া হয়ে একটা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কেননা, সাধারণ মানুষের রুটিরুজির ওপর ক্রমাগত আঘাত আসতে থাকলে, জীবনযাপনের প্রয়োজনগুলো মেটানো কঠিনতর হতে থাকলে তারা প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করতে বাধ্য। সীমিত ক্ষমতা ও হাজারো প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না, তবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রেখে যায় শাসকদের জন্য।


অতিসম্প্রতি দেশের গণপরিবহনে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে দুটি গণপ্রতিরোধ দেশের নীতিনির্ধারক তথা সরকারের প্রতি সে রকম বার্তাই দিয়েছে। গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই ঘটনা দুটি প্রকাশ পেয়েছে। তার পরও নীতিনির্ধারকেরা যেন তাঁদের নিস্পৃহতা বজায় রাখার ধারা আঁকড়ে ধরে থাকতেই বেশি আগ্রহী। আর যাঁরা নীতিনির্ধারকদের এই বিষয়ে নিস্পৃহ থাকতে উৎসাহিত করছেন, তাঁরা প্রকারান্তরে সরকার ও প্রশাসনকে গণবিরোধী অবস্থানে অটুট থাকতেই প্ররোচিত করেছেন। এবং এর মধ্য দিয়ে নিজেদের অর্থের থলে আরও ভারী করার তৎপরতা চালাচ্ছেন।
ভারিক্কি ধাঁচ ছেড়ে একটু সহজভাবে আলোচনা করা যাক। প্রথম ঘটনাটি রাজধানীর নিকটতম জেলা সদর নারায়ণগঞ্জের। নারায়ণগঞ্জের জনসাধারণের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে দেনদরবার করার জন্য সেখানকার নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে কয়েক বছর আগে গড়ে উঠেছে নাগরিক কমিটি। এই কমিটির নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার লোকজন আছেন। তাঁদের অনেকেরই আছে প্রগতিশীল সংস্কৃতি ও রাজনীতি চর্চার ইতিহাস। তাঁরা এবার জনসাধারণের পক্ষে মাঠে নেমে গণপ্রতিরোধের একটি সাহসী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর জের ধরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কপথের বাসমালিকেরা বাসভাড়া ২২ টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রথমে এক লাফে ৩০ টাকায় নিয়ে যান। এই অযৌক্তিক বাসভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে নাগরিক কমিটি সোচ্চার হয়ে ওঠে। কমিটি বাসভাড়া কমানোর দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেয়। গঠিত হয় যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম। চাপে পড়ে বাসমালিকেরা ভাড়া ৩০ টাকার বদলে ২৮ টাকা নেওয়ার কথা জানান। তবে নাগরিক কমিটি জানায়, ১৮ কিলোমিটার সড়কপথের ভাড়া কোনোভাবেই ২৪ টাকার বেশি হতে পারে না। কমিটি ভাড়া ২৬ টাকা নির্ধারণের দাবিতে হরতালের ডাক দেয়। বিষয়টি নিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ১৮ জুন এক বৈঠক ডাকে। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলের খবর থেকে জানা যায়, বৈঠকে নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে অযৌক্তিক বর্ধিত ভাড়া কমিয়ে আনার পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হচ্ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাবেক এক সাংসদ (যিনি ২০০১-০৬ সময়কালে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন) বাসমালিকদের পক্ষ নিয়ে ধমক দেন যে ‘এক পয়সাও ভাড়া কমানো হবে না’। বৈঠকে প্রকাশ্যে তিনি নারায়ণগঞ্জের একজন নির্বাচিত মহিলা সাংসদকে গালিগালাজ করেন এবং তাঁর দিকে তেড়ে যান। পরিণতিতে বৈঠক ভণ্ডুল হয়ে যায়। বৈঠক আয়োজনকারী জেলা প্রশাসনসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুরো সময়টা চুপচাপ বসে ছিলেন।
ঘটনার পর নাগরিক কমিটি পূর্বঘোষিত হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। হরতালের পক্ষে প্রচারণায় নামায় পুলিশ নাগরিক কমিটির নেতা-কর্মীদের অপদস্থ ও হয়রানি করে। আর বাসের মালিক-শ্রমিকেরা পুলিশি প্রহরায় রাস্তায় মিছিল করে নাগরিক কমিটির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। বাসভাড়া এক টাকা কমিয়ে ২৭ টাকা করায় শেষ পর্যন্ত হরতাল প্রত্যাহার করা হয়।
বাস্তবে অবশ্য ২৭ অথবা ২৮ টাকা রাখা হচ্ছে না। যাত্রী টিকিটের জন্য ৩০ টাকা দিলে একটি চকলেটসহ দুই টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে। পাইকারিভাবে সস্তা দরে সংগৃহীত চকলেটের দাম এক টাকা হতে পারে না। বাসমালিকেরা এটা বোঝাতে চাইছেন যে তাঁরা আসলে ২৭ টাকা ভাড়া নিতে রাজি নন। যদিও লোকদেখানোভাবে তা মেনে নিতে হচ্ছে।
কিন্তু পুরো ঘটনার তাৎপর্যপূর্ণ দিকটি হলো, গণপ্রতিরোধের কাছে ক্ষমতাশালী-প্রভাবশালী চক্রের পিছু হটা। যাঁরা ‘এক পয়সাও ভাড়া কমানো হবে না’ বলে ধমক দিয়েছিলেন, তাঁরাই ‘ভাড়া এক টাকা কমাতে বাধ্য হয়েছেন’। নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ পুরো বিষয়টিকে এভাবেই দেখছে। এটি নাগরিক কমিটির নৈতিক বিজয়। এ জন্য তাদের অভিনন্দন জানাই।
নাগরিক কমিটি আরেকটি বড় কাজ করেছে। দীর্ঘদিন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে বিআরটিসির বাস সার্ভিস বন্ধ রয়েছে। বেসরকারি পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চাপে এই রুটে বিআরটিসির বাস চলতে পারছে না। নারায়ণগঞ্জের নাগরিক কমিটি বিআরটিসি কর্তৃপক্ষসহ সরকার ও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে দেনদরবার করে এই রুটে আবার বিআরটিসির বাস চালানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এটাও নিঃসন্দেহে একটি সাহসের কাজ। যদিও বিআরটিসির বাস না চালানোর জন্য বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। সরকার ও প্রশাসনের কর্তব্য হলো নির্বিবাদে বিআরটিসির বাস চলতে দেওয়া। তা ছাড়া বেসরকারি বাসমালিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মূলত বাসের ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছে। তারা বিনিয়োগ না করে শুধু চাঁদাবাজি করতে আসেনি। বরং রাজনৈতিক মদদপুষ্ট গুটিকয়েক দুর্বৃত্ত এই পরিবহন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় তারাও অসহায়। বাস নষ্ট হলে, ভাঙলে বা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদেরই তা মেরামতের জন্য অর্থ ব্যয় করতে হয়। মালিক নামধারী চাঁদাবাজ-দুর্বৃত্তরা কোনো অর্থ ব্যয় করে না। প্রকৃত বাসমালিক ও শ্রমিকেরাও চান এই দুর্বৃত্তায়ন থেকে মুক্তি।
দ্বিতীয় ঘটনাটির দিকে তাকানো যাক। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ স্টেশন থেকে ভোর ছয়টায় ছেড়ে আসা ঢাকাগামী আন্তনগর ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেনটি সকাল সাড়ে আটটায় ময়মনসিংহ স্টেশনে এসে থামত। কিন্তু একজন সাংসদ রেল কর্তৃপক্ষের কাছে একটি ডিও লেটার পাঠান। এর পরিপ্রেক্ষিতে রেল কর্তৃপক্ষ গত জুলাই মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার থেকে সময়সূচি এমনভাবে বদলে দেয়, যেন ট্রেনটি ভোর সাড়ে পাঁচটায় ময়মনসিংহে এসে পৌঁছায়। ফলে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা অভিমুখী পথের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যাওয়ার জন্য ময়মনসিংহের মানুষের বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। সকালের বদলে রাত তিনটায় দেওয়ানগঞ্জ থেকে এই ট্রেনটি ছাড়ার ব্যবস্থা করায় কার্যত যাত্রীদের এই ট্রেনে চেপে যাতায়াত করার সুযোগও বন্ধ হয়ে যায়। স্পষ্টতই এই সময়সূচি বদলানোর উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে পুরোপুরি বাসনির্ভর করে তোলা।
কিন্তু ময়মনসিংহ উন্নয়ন পরিষদ এই অন্যায় ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। প্রথম দিনই এই পরিষদের ব্যানারে মানুষ ময়মনসিংহ স্টেশনে ট্রেনটি অবরোধ করে। তারা সাত দিনের মধ্যে সময়সূচি আগের অবস্থায় নিয়ে আসার সময়সীমা বেঁধে দেয়। শেষ পর্যন্ত রেল কর্তৃপক্ষ আগের সময়সূচিই বহাল রাখে। গণমানুষের পক্ষে মাঠে নামায় ময়মনসিংহ উন্নয়ন পরিষদকেও অভিনন্দন জানাতে হয়।
তবে রাজধানীকেন্দ্রিক সুশীল সমাজ ও নাগরিক সমাজের বড় বড় সংগঠন নারায়ণগঞ্জ বা ময়মনসিংহের জনমানুষের এই সাহসী কর্মকাণ্ডের প্রতি জোরালো সমর্থন জানাতে বড় কার্পণ্য দেখাল, যা নিতান্তই দুর্ভাগ্যজনক। রাজধানীর কাছে মফস্বল শহরের সমস্যা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়—এই মানসিকতা কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে জাতীয়ভাবে নাগরিক আন্দোলনকেই দুর্বল করে তুলবে।
ঘটনা দুটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শাসনক্ষমতার কাছাকাছি থাকা প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে সমীহ করে চলে প্রশাসন। অথচ লাখ লাখ সাধারণ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ও সহায়ক ভূমিকা নিতে তাদের যেন বড়ই অনীহা। এই অনীহা আরও জোরদার হয় রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের নিস্পৃহ মনোভাবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী তথা সরকার যত দ্রুত এই নিস্পৃহ মনোভাব ঝেড়ে ফেলবে এবং জনপ্রতিরোধের বার্তাটি আমলে নেবে, ততই দেশের মঙ্গল।
আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.