সংগীত ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ: একটি ভাবদর্শন by এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার

ইতিহাসের নানা কালপর্বে বাঙালির অভিজ্ঞতা তার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির প্রকাশকেও বিভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। এ কারণেই আমরা দেখি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বাঙালি কবি মুকুন্দদাসের ডাক 'ভয় কী মরণে রাখিতে সন্তানে', বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের উচ্চারণ 'কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট', আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী গান 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি'।


সংগীতের শক্তি অসীম। যেখানে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শক্তি বিপরীতধর্মী কিংবা শত্রুশক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে, সেখানেও সাংগীতিক শক্তি চূড়ান্ত সত্যের পক্ষে, মানবতার পক্ষে সমবেদনা ও সহমর্মিতা দেখাতে সক্ষম হয়। জর্জ হ্যারিসন বা পণ্ডিত রবিশংকর কর্তৃক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে খোদ আমেরিকায় কনসার্ট করে শরণার্থীদের জন্য অর্থ ও মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বিশ্ববাসীর দরবারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থান তুলে ধরার প্রচেষ্টা সংগীতের বিশ্বশক্তিমত্তার এক অনন্য স্বাক্ষর। যুদ্ধ যখন অনিবার্যভাবে কোনো জাতির মুক্তির একমাত্র বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়, তার অস্তিত্বের সংগ্রাম হয়ে দাঁড়ায়, হয়ে দাঁড়ায় আত্মপরিচয় বিনির্মাণের অবিকল্প পটভূমি- আর সেই জাতি যদি হয় মেধা-মননে হৃষ্ট, ভাষা-সংস্কৃতির ঐতিহ্যের দীর্ঘ ইতিহাসে গৌরবান্বিত, তাহলে তার বাসনা পূরণের মাধ্যম হিসেবে সংগীত কেবল প্রেরণার উৎস হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং তা হয়ে ওঠে অস্ত্রের সমকক্ষ, কখনো বা তার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গান ও তার ভাবদর্শন বিশ্লেষণ করতে গেলে এই ধারণাটি আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিফলিত হয় যে 'বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ যতটা রাজনৈতিক, যতটা অর্থনৈতিক, ঠিক ততটাই সাংস্কৃতিক ভিত্তিভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত।' একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালিকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলেও বিস্ময়করভাবে এ জাতির সাংস্কৃতিক বিকাশের গৌরবধারা বহমান ছিল হাজার বছর ধরে।
বস্তুত, বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিকাশের মূলধারার মূল সুর একটাই, আর তা হলো উদার অসামপ্রদায়িক চেতনার সাম্যবাদী বাঙালি। সে কারণেই বুঝি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে আলী মহসীন রেজার কথায় ও খাদেমুল ইসলাম বসুনিয়ার সুরে কণ্ঠযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথের গেয়ে ওঠা, 'ছোটদের বড়দের সকলের, গরীবের নিঃস্বের ফকিরের... আমার এ দেশ সব মানুষের... 'হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান, দেশ মাতা এক সকলের...' গানটি বিশেষ ব্যঞ্জনা নিয়ে প্রতিভাত হয়। একইভাবে শোনা যায়, গৌরি প্রসন্ন মজুমদারের 'বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ' কিংবা কার্তিক কর্মকারের 'ভাইরে ভাইরে ভাই হিন্দু মুসলমান পরাধীনতার শৃঙ্খল আজি হয়ে যাক খান খান।' 'বাঙালি মুসলমানের মানসপট ও বাঙালি সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব' বিষয়ক আলোচনায় কেউ কেউ ভিন্ন যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টা করলেও এটি প্রতিষ্ঠিত যে বাঙালির মূলধারার চেতনা সর্বদাই অসাম্প্রদায়িক, উদার ও ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত, যার মধ্যে বাঙালির সহজাত বাউল-ভাটিয়ালি, জারি-সারি, পল্লী গান আর বৈরাগী চেতনার পাশাপাশি গণসংগীতের মতো সংগ্রামী রূপও দেখা যায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রথমবারের মতো বাঙালি তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শামিল হয় নিজ 'জাতিরাষ্ট্র গঠনের' যোদ্ধা হিসেবে বাঙালি উজ্জীবিত হয় পরাধীনতার শেকল ভাঙার জীবন মরণ পণে। বাঙালি জাতির ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গৌরবময় এই কালপর্ব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানে সৃষ্টির বীজ আগেই গ্রোথিত ছিল। ভেতরে ভেতরে তা শুধু বিকশিত হওয়ার বাসনায় সুপ্ত ছিল। প্রস্তুত হয়েই ছিল স্বপ্নদ্রষ্টার ডাকে সাড়া দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই অনবদ্য কাব্যিক আহ্বান 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' যেন হাজার বছরের বাঙালির প্রাণের গণসাংগীতিক উচ্চারণ। আনুষ্ঠানিক এই 'ডাক' 'সাংস্কৃতিকভাবে প্রস্তুত' বাঙালি জাতিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করল তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে। বাংলা ও বাঙালির জয়গানই ছিল সে যুদ্ধের মূলমন্ত্র। তাই তো গীতিকার মাজহারুল আনোয়ার রচনা করলেন কালজয়ী গান- 'জয় বাংলা বাংলার জয়/হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়/কোটি প্রাণ এক সাথে জেগেছে অন্ধ রাতে/নতুন সূর্য উঠার এইতো সময়।' বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গানে শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চিত্রের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব সম্মিলন দেখা যায়। অবশ্য এই ধারাটি মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব বাঙালির অন্যান্য রাজনৈতিক সংগ্রামের সময়ও পরিলক্ষিত হয়েছে। যেমন ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আবদুল লতিফের জারির সুরে রচিত অমর সৃষ্টি 'ওরা আমার মুখের কথা (ভাষা) কাইড়া নিতে চায়/ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়' আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় গীত হয়েছে- 'মুক্তির একই পথ সংগ্রাম/অনাচার অবিচার শোষণের বিরুদ্ধে/ঘরে ঘরে গড়েছি দুর্জয় প্রতিরোধ দুর্গ/তাদের আজ প্রতিহত করবোই করবো।' (শহীদুল ইসলাম-গীতিকার)। মুক্তিযুদ্ধের গান হিসেবে যে গানগুলো বিবেচিত হয়, তা কেবল মুক্তিযুদ্ধকালীন রচিত তা নয়, বরং আবহমান বাঙালি জাতিসত্তার মূল চেতনাকে ধারণ করে (বিভিন্ন রাজনৈতিক কালপর্বের প্রেক্ষাপটসহ) সংগীতের যে ধারাটি বহমান ছিল তা এক নতুন ব্যঞ্জনায় সময়ের প্রেক্ষাপটে নতুন উপযোগিতা নিয়ে প্রতিভাত হয়।
লেখক : গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী।

No comments

Powered by Blogger.