সাগর-রুনি হত্যা-তদন্তকাজ অবশ্যই প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে by আসাদ উল্লাহ খান

টিভি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির নৃশংস ও মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে সমগ্র দেশের মানুষ শোকাহত ও স্তম্ভিত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের একাধিক তদন্তকারী দল দিয়ে এই হতাকারীদের শনাক্ত করা এবং হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রতীয়মান হয়, হত্যাকারী চক্র অত্যন্ত ধূর্ত, ধুরন্ধর ও শক্তিশালী।


যেহেতু হত্যাকাণ্ড চালানোর সময় তাদের কেউ দেখতে পায়নি, তাই প্রচলিত পদ্ধতিতে তাদের শনাক্ত করা এবং মামলায় দাঁড় করানো বেশ কঠিন হবে। তবে এই হত্যাকারীরা তাদের অজান্তে অনেক চিহ্ন, অনেক প্রমাণ রেখে গেছে।
বিজ্ঞানের এই অভাবনীয় উন্নতির যুগে এগুলো সময়মতো যদি সংগ্রহ করা হয় এবং সংরক্ষিত থাকে, তাহলে এগুলো কাজে লাগিয়ে হত্যাকারী শনাক্ত করা সম্ভব। নিহত ব্যক্তিদের ময়নাতদন্তের সময় ফরেনসিক চিকিৎসকেরা হত্যাকারীদের হাত-পায়ের ছাপ সংরক্ষণ করেছেন বলে জানা জানা গেছে। আজকের এই যুগে ডিএনএ টেস্টের সাহায্যে অপরাধী ও হত্যাকারী শনাক্ত করা খুবই সহজ এবং এই শনাক্তকরণ পদ্ধতি শতভাগ সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবে এ প্রক্রিয়ায় অবশ্যই সন্দেহভাজন অপরাধীদের ডিএনএ প্রোফাইলিং থাকতে হবে। পুলিশ ও র?্যাব ইতিমধ্যে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের একটা তালিকা তৈরি করেছে। অপরাধকর্ম চালানোর সময় অর্থাৎ ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর বা পোশাকে অপরাধীর শরীরের ঘাম, মুখের লালা, রক্ত এবং পাশবিক নির্যাতন হলে কয়েক মিলিলিটার পরিমাণ শুক্রকণা পড়ে থাকলেও ওই নমুনা দিয়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ডিএনএ প্রোফাইলিং মিলিয়ে প্রকৃত অপরাধী শনাক্তকরণের পদ্ধতি এখন শতভাগ সঠিক ও সন্দেহাতীত বলে প্রমাণিত হয়েছে।
বছর দশেক আগে কার্ডিফের ওয়েলসের (ইংল্যান্ড) কলেজপড়ুয়া একটি মেয়ের ওপর ধর্ষণ ও তৎপরবর্তী হত্যার ঘটনাটা ওই এলাকায় যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছিল। কলেজপড়ুয়া ক্লেয়ার হুডকে (১৮) একটি আবাসন প্রকল্পের পাশে গাছগাছালিভরা জায়গায় নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। কার্ডিফের পুলিশ এই ধর্ষক-হত্যাকারীকে শনাক্ত করার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। নিহত মেয়েটির পরিহিত পোশাকে পুলিশ জমাট বাঁধা সাদা কণা দেখতে পেল। পুলিশ এই সাদা কণা শুক্রকণা মনে করে তৎক্ষণাৎ সংরক্ষণ করল। এরপর পুলিশ যেটা করল সেটা খুবই চাঞ্চল্যকর ও সব দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য শিক্ষণীয়। ওই এলাকার ১১ হাজার বাসিন্দার মধ্যে দুই হাজার পুরুষ বাসিন্দাদের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে রক্তের নমুনা সরবরাহের জন্য আহ্বান জানানো হলো এবং এটাও জানানো হলো, যারা আহ্বানে স্বেচ্ছায় সাড়া দেবে না, তাদের গ্রেপ্তার করে রক্তের নমুনা নেওয়া হবে। গ্রেপ্তারের ভয়ে সবাই সাড়া দিল। রক্তের নমুনা সরবরাহকারীদের একজনের ডিএনএ নিহত ছাত্রীর দেহে পাওয়া শুক্রকণার ডিএনএর সঙ্গে ম্যাচিং হলো। প্রোফাইল ম্যাচিং করে অপরাধীকে শনাক্ত করতে পুলিশ সক্ষম হলো। বিশেষজ্ঞদের মতে, শতভাগ সত্যতা নিরূপণের স্বার্থে একটি নমুনা নয়, বেশ কয়েকটি নমুনা পৃথক করে রাখতে হবে। এ জন্য ব্যবহূত পোশক সন্দেহাতীতভাবে পরিষ্কার ও দূষণমুক্ত হতে হবে এবং সংরক্ষণের পদ্ধতি প্রশ্নাতীতভাবে প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে।
উন্নত বিশ্বের আমেরিকা ও ইউরোপেও সব সময় ঘটনাস্থলে অপরাধী ধরা পড়ছে না; তাই বলে তারা হাত গুটিয়ে বসে নেই। আমেরিকার একটি অপরাধচিত্র ও অপরাধী শনাক্ত করার বিষয় এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে: ১৯৭৭ সালে আমেরিকার ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের রবিনসন শহরে স্কুলশিক্ষিকা ডেবোরা জিনেট কর্মস্থলে যাওয়ার পথে অপহূত হওয়ার পর ধর্ষিত হন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করার পর হত্যাকারী পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সটকে পড়ে। পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে হত্যাকারী ডেভিড রবার্ট কেনেডিকে চিহ্নিত করলেও সঠিক প্রমাণের অভাবে তাকে গ্রেপ্তার করতে পারছিল না। বিস্ময়কর বটে! ডেবোরার জিনসের প্যান্টে ধর্ষণের প্রমাণ হিসেবে যে সামান্য পরিমাণ শুক্রকণিকা ছিল, তা দিয়ে ১৯৭৭ সালের জেনেটিকবিজ্ঞানের অগ্রগতির নিরিখে ডাটা ব্যাংকে সংরক্ষিত ডেভিডের ডিএনের সঠিক যোগসূত্র মেলানো যাচ্ছিল না। কিন্তু পুলিশ হাল ছাড়েনি। পুলিশের কৃতিত্ব এখানেই যে ওই সন্দেহভাজন ব্যক্তির ডিএনএ ডাটা ব্যাংকে সংরক্ষণ করে রেখেছিল। জেনেটিকবিজ্ঞান ও ডিএনএ পরীক্ষা ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। ২৩ বছর পর ২০০০ সালে ডেবোরার প্যান্টে পাওয়া শুক্রকণিকার ডিএনএ বর্তমান সময়ে ওই অঞ্চলের একটি বিমান সংস্থার মেকানিক ডেভিডের (৪৮) ডিএনএর সঙ্গে আবার মেলানো হলো। ডেভিডের ডিএনএর সঙ্গে ডেবোরার প্যান্ট থেকে সংগৃহীত শুক্রকণিকার ডিএনএর সুনির্দিষ্ট জেনেটিক লিঙ্ক অর্থাৎ যোগসূত্র পাওয়া গেল। ডেভিডকে গ্রেপ্তার করা হলো এবং সে তার অপরাধ স্বীকার করল। ওই অঞ্চলের পুলিশ সংস্থা ও ডিএনএ পরীক্ষাগারকে এই অদম্য প্রয়াসের জন্য পুরস্কৃত করা হয়েছে। ভারতের আদালতে ডিএনএ পরীক্ষা আইনি মর্যাদা লাভ করেছে। ১৯৯৬ সাল থেকে ভারতের কেরালা প্রদেশের আদালত ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত প্রমাণকে সন্তানের পিতৃত্বের দাবি বা অধিকারকে মেনে নিয়েছে।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য এখনও উন্মোচিত হয়নিএবং খুনিরাও ধরা পড়েনি। পুলিশের তদন্তকারী দল বলছে, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব আলামত সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেটিই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কারণ, খুনের মোটিভ সন্ধানের আগে খুনিদের খুঁজে বের করা দরকার।
সময় যত গড়াবে অনেক সাক্ষ্যপ্রমাণ হারিয়ে যাবে। তখন এই আলামতগুলো বেশি প্রয়োজন হবে। হাতের আঙুলের ছাপ ও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আলামত যথা খুনিদের চুলের একটি মাত্র আঁশ, মুখের লালা, রুনি-সাগরের কাপড়ে জড়িয়ে থাকা খুনিদের কয়েক ফোঁটা ঘাম ও রক্ত বিজ্ঞানসম্মতভাবে সংরক্ষণ করা খুবই প্রয়োজন। ২৩ বছর পর আমেরিকার ইলিনয় রাজ্যের স্কুলশিক্ষিকার খুনিকে তো এভাবেই শনাক্ত করা হয়েছে। খুনি ধরা পড়লেই খুনের মোটিভ ও খুনের মদদদাতাদের খুঁজে পাওয়া যাবে।
আসাদ উল্লাহ খান: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক।
aukhandk@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.