চরাচর-হাঁড়ি-পাতিলের কুমারপাড়া by সাইফুল ইসলাম খান

টিভি পর্দায় কুমারের চাকাকে আমরা যতটা দ্রুত ঘুরতে দেখি, তাদের জীবনের চাকা কিন্তু অতটা দ্রুত ঘোরে না। বরং তাদের জীবনরথের গতি তার উল্টা। অসম্ভব ধীর। আধুনিক বা সমসাময়িক প্রযুক্তির যুগে বসবাস করেও তারা যেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাসিন্দা। অতীতে তাদের জীবনেও সোনালি দিন ছিল; তখন প্রাচুর্য না থাকলেও এখনকার মতো অভাবের


ঘনঘটা ছিল না_এমন ধারণা পোষণ করেন কড়িহাতার কুমার পল্লীর মাটির শিল্পী রবীন্দ্র পাল। কড়িহাতার কুমারপাড়া গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার অন্তর্গত একটি গ্রাম। এ গ্রামে প্রায় ১৫০ ঘর কুমার বাস করে। ছোট-বড়, নারী-পুরুষ মিলিয়ে এ পল্লীর সদস্যসংখ্যা প্রায় ৭০০। শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারবঞ্চিত এ পল্লীর মানুষের জীবনাচরণ অত্যন্ত সাদাসিধে। মাটির জিনিস তৈরির জন্য মাটি সংগ্রহ করা, যথাযথভাবে মাটি গুলিয়ে মণ্ড তৈরি করা, সেই মণ্ড দিয়ে হাঁড়ি-পাতিলের আকৃতি করার কাজটি চলে একনাগাড়ে দিন বিশেক। এরপর তিন-চার হাজার হাঁড়ি-পাতিল একসঙ্গে 'পুন'-এ দুই দিন পোড়ানো। 'পুন' হলো হাঁড়ি-পাতিল পোড়ানোর ছোট চুলা, যা অনেকটা ইটখোলার চুল্লির মতো। কুমারদের জীবনপ্রবাহ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে নূ্যনতম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তারা গ্রহণ করে। কর্মজীবনে প্রত্যেক কুমার যেন একজন শিল্পী। একজন প্রকৃত শিল্পীর মতোই খাঁটি দরদ দিয়ে, মাটি দিয়ে তারা তৈরি করে হাঁড়ি-পাতিল এবং কলস থেকে শুরু করে তামাক খাওয়ার কল্কেটি পর্যন্ত। অবশ্য হুঁকার ব্যবহার কমে যাওয়ায় তাদের আর আগের মতো কল্কে বানাতে হয় না। যেমন আগের মতো অতটা চাহিদা নেই মাটির হাঁড়ি-পাতিলের। হুঁকার জায়গায় যেমন এসেছে সিগারেট, তেমনি মাটির হাঁড়ি-পাতিলের জায়গা দখল করে নিয়েছে মাইক্রোওভেন কিংবা নানা ধরনের ইলেকট্রিক কুকার। একই হারে কমছে তাদের আয়, কমছে এ পেশাজীবীদের সংখ্যা। বাংলাদেশের সর্বত্রই কুমার পেশাজীবীরা বসবাস করে। তাদের বসবাসের প্রক্রিয়া সাধারণত গোষ্ঠী ও স্থানভিত্তিক। পেশাগত কারণে কুমারদের সংস্কৃতিতে কিছুটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। মাটির জিনিসপত্র তৈরি করা শুধুই শ্রমসাধ্য নয়; এতে প্রয়োজন অখণ্ড মনোযোগ ও পর্যাপ্ত সময়ের। তাই কুমার পল্লীর মানুষরা অনেকটা অন্তর্মুখী। সন্তান লালন-পালন ও রান্নাবান্নায় নূ্যনতম সময় ব্যয় করে অবশিষ্ট সময় নারীরা ব্যয় করে তাদের শিল্পকর্মে। আর পুরুষরা তাদের উৎপাদিত জিনিসপত্র হাট-বাজারে ও লোকালয়ে বিক্রি করেই বেশির ভাগ সময় ব্যয় করে। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে বসবাস করেও তারা প্রযুক্তির বিনোদন, শিক্ষা কিংবা রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরের মানুষ। তাদের ধ্যান-জ্ঞান শুধুই মাটি আর মাটির তৈরি নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরিতে সীমাবদ্ধ। যথেষ্ট লাভজনক না হলেও 'পূর্বপুরুষের পেশায় টিকে থাকা' তাদের অনেকেই পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে জ্ঞান করে। চিরায়ত বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনে যেমন তাদের তৈরি সামগ্রী অপরিহার্য, তেমনি দেশের স্বার্থেই প্রয়োজন তাদের জীবনে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া। এর জন্য বড় কোনো প্রকল্পের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই যথেষ্ট অর্থ ব্যয়ের। শুধু প্রয়োজন তাদের মধ্যে একটু সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া। রাষ্ট্রের কর্তব্য হিসেবে সরকারই পারে এ দায়িত্বটুকু গ্রহণ করতে।
সাইফুল ইসলাম খান

No comments

Powered by Blogger.