সাক্ষাৎকার-অর্থনীতির সম্ভাবনার সঙ্গে অবকাঠামো তাল মেলাতে পারছে না by আবদুর রহিম চৌধুরী

সাক্ষাৎকার গ্রহণ :অজয় দাশগুপ্ত যুক্তরাষ্ট্রের মার্কুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুর রহিম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গ্রহণের পর বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকাস্থ আবাসিক মিশনে কাজ করেছেন।


এ ছাড়াও কাজ করেছেন ব্যাংককের থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র ফুলব্রাইট স্কলার, যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পরামর্শক হিসেবে। ঢাকায় অবস্থানকালে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক
ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ে


সমকাল : বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়েই আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। মন্দা কাটিয়ে তারা কি ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে?
রহিম চৌধুরী :এখনও বিশ্বের সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাক্রমশালী দেশটির চিত্র ভালো নয়। সর্বশেষ কোয়ার্টারে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ১.৩ শতাংশ। ব্যাপক মন্দা পরিস্থিতি তারা কাটিয়ে উঠেছে। কিন্তু পুনরুদ্ধার যতটা আশা করা হয়েছিল, সেটা হয়নি।
সমকাল : যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঋণ করার বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশটির সরকারকে কেন এত বেশি ঋণ করতে হয়?
রহিম চৌধুরী : অঙ্কটি সোজা_ সরকারের রাজস্ব আদায়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। তাদের জিডিপির ১৬ শতাংশের মতো বছরে কর হিসেবে আদায় করা হয়। আর ব্যয়ের পরিমাণ ২৫ শতাংশের মতো। এ ঘাটতি মেটায় জনসাধারণের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে। সাধারণত সরকার বন্ড ছেড়ে এ ঋণ নিয়ে থাকে।
সমকাল : সরকার চাইলেই যত খুশি ঋণ নিতে পারে?
রহিম চৌধুরী : না, এর পরিমাণ কংগ্রেস ঠিক করে দেয়। এতদিন ঋণের সিলিং ছিল ১৪.৩ ট্রিলিয়ন ডলার, যার সবটাই প্রায় ওবামা সরকার নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সরকারের ব্যয় যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে ঋণের সিলিং না বাড়ানো হলে ডিফল্টার বা খেলাপি হয়ে পড়ার লজ্জায় পড়তে হবে। কংগ্রেসের সঙ্গে ঋণের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো নিয়ে নয়, বিবাদ শর্ত নিয়ে। ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটরা বলছে, মন্দা-পরবর্তী সময়ে খুব ধীরে ধীরে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এ সময়ে সরকারের ব্যয় কমানো ঠিক হবে না। তাদের আরও প্রস্তাব ছিল_ ধনীদের ওপর করের বোঝা বাড়ানো। অন্যদিকে বিরোধী রিপাবলিকানদের ধনীদের ওপর করের বোঝা বাড়াতে বরাবরই আপত্তি। তাদের যুক্তি_ এতে বিনিয়োগ করায় আগ্রহ হারাবেন শিল্পপতিরা।
সমকাল : মার্কিন সরকারকে এত বেশি ঋণ করতে হয় কেন?
রহিম চৌধুরী :একটি কারণ বিপুল সামরিক ব্যয়। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়াসহ বিশ্বের নানা স্থানে তাদের ব্যয়ের বহর অনেক। সামাজিক নিরাপত্তা খাতেও যথেষ্ট ব্যয় করতে হয়।
সমকাল :যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তাবাজার। অনেক দেশের সঙ্গেই তাদের বাণিজ্য ঘাটতি। চীন-জাপান তো রয়েছেই, এমনকি বাংলাদেশ থেকেও তাদের যত আমদানি, তার তুলনায় রফতানি যথেষ্ট কম। এ অবস্থার কি পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে?
রহিম চৌধুরী : যুক্তরাষ্ট্রে জিডিপির ১০ শতাংশের মতো রফতানি এবং ১২-১৩ শতাংশ আমদানি। এক সময়ে দেশটিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাত ছিল এগিয়ে। কিন্তু কয়েক দশকে সার্ভিস খাত এগিয়ে গেছে। এখন আবার ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে জোর পড়ছে। এর একটি কারণ চীন ও ভিয়েতনামের মতো দেশে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি। সেখানে বিনিয়োগ করে তা থেকে উৎপাদিত দ্রব্য আমদানি করলে যা ব্যয়, এর পরিবর্তে দেশে উৎপাদন ব্যয় কম। এখানে কিন্তু বাংলাদেশের জন্য সুযোগ রয়েছে।
সমকাল : কী ভাবে?
রহিম চৌধুরী : আমাদের দেশে শ্রমের ব্যয় এবং সার্বিকভাবে উৎপাদন ব্যয় চীন ও ভিয়েতনামের তুলনায় যথেষ্ট কম। এ কারণে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারি। তবে এ জন্য কিছু শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে। যেমন, অবকাঠামোর উন্নতিসাধন। উন্নত দেশগুলোর বিনিয়োগকারীরা কস্ট এফেক্ট ও বিনিয়োগ পরিবেশের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়। তারা রেটিং দেখে নিয়মিত। একটি বিদেশি কোম্পানি চালু করতে কোন দেশ কতদিন সময় নেয়, সেটা তারা জানতে চায়। বিদ্যুৎ ও অন্যান্য পরিসেবা, বন্দর সুবিধা_ এসব তাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। লালফিতার দাপট-দৌরাত্ম্য সম্পর্কে তারা খোঁজ নেয়। আমাদের বিভিন্ন দূতাবাসের কাজ হওয়া উচিত এসব ক্ষেত্রে কী পরিবর্তন ঘটছে সেটা নিয়মিত তুলে ধরা।
সমকাল : যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত পুনরুদ্ধার কেন হচ্ছে না?
রহিম চৌধুরী : মন্দা কাটিয়ে উঠতে ওবামা সরকার ফেডারেল রিজার্ভ থেকে তিন বছরে তিন ট্রিলিয়ন ডলার বা তিন লক্ষ কোটি ডলার অর্থনীতিতে ঢেলেছে। প্রণোদনা প্যাকেজে ছিল আরও ৮০০ কোটি ডলার। কিন্তু এখনও বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মধ্যে আস্থা পুরোপুরি ফিরে আসেনি। একদল লোকের কাছে প্রচুর অর্থ রয়েছে। কিন্তু অনিশ্চয়তা কাটছে না। এর একটি কারণ ইউরোপের সমস্যা। এ কারণে মার্কিন ডলারের দাম কমে যাচ্ছে। আরেকটি সমস্যা হাউজিং খাতের কারণে।
সমকাল : হাউজিং সমস্যা কেন?
রহিম চৌধুরী : যুক্তরাষ্ট্রের বিপুলসংখ্যক লোক ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি কিনেছে। এ জন্য ব্যাংকগুলোও উৎসাহিত করেছে। একটা সময় ছিল যখন বাড়ির দাম কেবল বাড়ছিল। ফলে এ খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত হয়। মধ্যবিত্ত যাদের বলি, তারা দলে দলে বাড়ি কিনতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করে বাড়ির দাম পড়ে যেতে শুরু করে। ফলে অনেক মালিক কিস্তির অর্থ ব্যাংকে পরিশোধ করতে পারছিলেন না। তাদের বাড়ি চলে যায় ব্যাংকের হেফাজতে। এ ধরনের বাড়ির সংখ্যা ৪০ লাখের মতো। ব্যাংকগুলো এত বিপুলসংখ্যক বাড়ি দিয়ে কী করবে? তারা ক্রেতা পাচ্ছে না। যাদের পাওয়া যায়, তারা কম দামে কিনতে চায়। কিন্তু ব্যাংকগুলো লোকসান দিয়ে বাড়ি বিক্রি করতে চায় না। তারা বলছে, সরকার তাদের লোকসান এড়াতে ভর্তুকি দিক।
সমকাল : বেকারত্ব সমস্যা এখনও প্রকট...।
রহিম চৌধুরী : বেকারত্বের হার মোট শ্রমশক্তির ৯ শতাংশ এবং হাউজিং খাতে সমস্যার এটাও কারণ। তাদের চাকরি না থাকায় বাড়ি কিনছে না এবং এর ফলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ব্যাহত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন এক বছর বা তারও বেশি সময় ধরে কাজ নেই এমন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এদের মধ্যে হতাশা বেশি এবং অনেক সময় ধরে কাজ না করার কারণে দক্ষতা কমে যাচ্ছে। বেকারত্বের হার বেশি হওয়ায় দেশের বাজারে প্রভাব পড়ছে। এদের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। তবে আবারও বলছি, বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এ পরিস্থিতি সহায়ক হতে পারে, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের বাজারে।
সমকাল : কী ভাবে, একটু ব্যাখ্যা করুন...।
রহিম চৌধুরী :আমাদের তৈরি পোশাকের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র। গত কয়েক বছর সেখানে মন্দা চলার পরও আমাদের রফতানি কমেনি। অথচ অনেক দেশের রফতানি কমেছে। আমরা এখনও তুলনামূলক কম দামে পোশাক দিতে পারছি। আরেকটি কারণ, আমরা তুলনামূলক কমদামি পোশাক রফতানি করি।
সমকাল : মার্কিন ডলারের মান পড়ছে বিশ্বব্যাপী, কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র বিপরীত_ ডলারের তুলনায় টাকা ক্রমে মান হারাচ্ছে। এমনটি কেন ঘটছে?
রহিম চৌধুরী :এখানে ডলারের চাহিদা বেশি। এর একটি কারণ আমদানি বাড়তে থাকা। আরেকটি কারণ কালো টাকা। এর পরিমাণ অনেক বলেই ধারণা করা হয়। এ অর্থের একটি অংশ ডলারে রূপান্তরিত হচ্ছে। বিশ্বে ডলারের মান কমছে কিন্তু এখানে দাম চড়া_ এর কিন্তু নেতিবাচক দিক রয়েছে_ আমরা কমদামি জিনিস কিনছি বেশি দামে।
সমকাল :গ্রামীণ ব্যাংক ও অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্রে কী ভাবে দেখা হচ্ছে?
রহিম চৌধুরী : বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পাশ্চাত্যে সাধারণভাবে নেতিবাচক। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি এবং অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, উভয় কারণেই বাংলাদেশের জন্য কিছুটা ইতিবাচক অবস্থান গড়ে উঠছিল। সরকার কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটা স্পষ্ট করতে পারেনি। এ কারণে সামগ্রিক বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষে যায়নি।
সমকাল : বাংলাদেশে এসে সবচেয়ে কোন বিষয়টি ভালো লেগেছে?
রহিম চৌধুরী : মূল্যস্ফীতি আছে। যানজট তীব্র। তারমধ্যেও মানুষের মধ্যে আশাবাদ বাড়ছে, বিশেষ করে অনেক মানুষ মনে করছে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও ভালো হতে পারে। এ দেশটি এখন আর হেনরি কিসিঞ্জার কথিত বাস্কেট কেস নয়। উন্নত বিশ্বেরও অনেকে মনে করে, যেসব দেশ বিশ্বের প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। এ ধরনের দেশকে বলা হয় থ্রি জি_ গ্গ্নোবাল গ্রোথ জেনারেটর। এক সময়ে আমাদের বলা হতো ফ্রন্টিয়ার ইকোনমি_ এখন বলছে থ্রি জি।
সমকাল : সবচেয়ে খারাপ কী লাগছে?
রহিম চৌধুরী : অর্থনীতির যে সম্ভাবনা তার সঙ্গে অবকাঠামো তাল মেলাতে পারছে না। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাত-প্রবণতাও উদ্বেগজনক পর্যায়ে।
সমকাল : যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসরতদের মধ্যে দেশে বিনিয়োগে আগ্রহ কেমন?
রহিম চৌধুরী : নানা দেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের হাতে দেশে বিনিয়োগ করার মতো প্রচুর অর্থ রয়েছে। এখানে অনেক সমস্যা। তারপরও বলব, দেশের সার্বিক অগ্রগতিকে তারা ইতিবাচক মনে করে। আমাদের দূতাবাসগুলো দেশে তাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা বাড়াবে, এটাই প্রত্যাশা থাকবে।
সমকাল : আপনাকে ধন্যবাদ।
রহিম চৌধুরী : সমকালের সব পাঠককে ধন্যবাদ।
 

No comments

Powered by Blogger.