ইউরোপের চিঠি-মিসরে গণ-আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি, না নতুন পর্যায় by পিটার কাস্টার্স

মিসরে এখন কী ঘটছে? জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির গণ-আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি, নাকি নতুন পর্যায় প্রত্যক্ষ করছি আমরা? জুলাইয়ের প্রথমার্ধে যেসব গণজমায়েত দেখা গেছে, সেগুলো দেখে মনে হতে পারে বছরের শুরুর দিককার গণ-আন্দোলনেরই পুনরাবৃত্তি। ঘৃণ্য স্বৈরশাসক মোবারককে উৎখাতের মাস ছয়েক পর আবার দেশটিতে প্রতিবাদ-


বিক্ষোভ তুঙ্গে। ৮ ও ১৫ জুলাই জুমার নামাজের পর তাহরির স্কয়ারে বিপুলসংখ্যক মানুষ সমবেত হয়। কয়েক মাস আগেও এই ময়দান হয়ে উঠেছিল মোবারকবিরোধী বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দু। আবার মিসরীয় জনগণের প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তু হয়েছে রাষ্ট্রের নিপীড়নযন্ত্র। তারা পুলিশ বাহিনীতে শুদ্ধির দাবি তুলেছে; মোবারকের সহযোগীদের দ্রুততর বিচার সম্পাদন এবং সামরিক আদালতে বেসামরিক নাগরিকদের বিচার বন্ধেরও দাবি তুলেছে। সামরিক পরিষদ আবারও বিক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশটির সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণ-প্রক্রিয়ার ভার নিজের কাঁধে নিয়ে নেয় এই সামরিক পরিষদ। বিক্ষোভ প্রশমনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানসুর এল-ইসাবি ১৫ জুলাই গণজমায়েতের আগে আগে পুলিশের অভ্যন্তরে ইতিহাসের ‘বৃহত্তম রদবদল’ ঘটানোর ঘোষণা দিয়েছেন। ছয় শতাধিক জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাকে অকালীন অবসরে পাঠানো হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তথাপি, বিপুল জনগণ নিজেদের অবস্থান থেকে সরে যেতে রাজি হয়নি। ১৫ জুলাই ভূমধ্যসাগরীয় আলেকজান্দ্রিয়া নগরেও পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরই পদত্যাগ চায়! এসব কিসের লক্ষণ? নিপীড়নমূলক শাসনের বিরুদ্ধে মিসরের জনগণের বিরুদ্ধতার পুনরাবৃত্তি? নাকি নতুন কিছু ঘটে চলেছে?
চলতি বছরের শুরুতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে যেসব ঘটনা, সেসবের ‘পুনরাবৃত্তি’ হলে তা হয়তো ঠিকই হতো। সে সময় ইন্টারনেটে ‘৬ এপ্রিল আন্দোলন’ নামে একদল তরুণের আহ্বান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ফেসবুক ব্যবহার করে তারা বন্ধুদের বিক্ষোভে শামিল হতে আহ্বান করেছিল। এসব কথা সবারই জানা। তবে কম জানা ব্যাপার হলো, কায়রোর তরুণেরা এই আন্দোলনের প্রেরণা পেয়েছিলেন দেশটির সর্ববৃহৎ বস্ত্র কারখানা ‘মিসর’-এর শ্রমিকদের কাছ থেকে। তাঁদের সংগঠনের নাম ও উদ্দীপনার উৎস ২০০৮ সালের ৬ এপ্রিল কারখানার শ্রমিক ধর্মঘট। প্রচারণা শুরুর আগে তাঁরা সেসব শ্রমিকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
বছরের শুরুতে স্বৈরতন্ত্রবিরোধী বিদ্রোহের আগে আগে খুব তাৎপর্যপূর্ণ কিছু শ্রমিক ধর্মঘট ডাকা হয়। বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ সামির আমিনের মতে, মিসরে ২০০৮ সালের ধর্মঘটগুলো অত্যন্ত সফল হয়েছে। তাঁর মতে, এসবের ফলে মজুরি বেড়েছে গড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম চালানোর সুযোগও বেড়েছে। ২০১০ সালে আবারও মিসরে কয়েক দফায় শ্রমিক-সংগ্রাম দেখা গেছে। আদালতের উচ্চপর্যায়ের একটি রায় এসবে প্রণোদনা জুগিয়েছে। সে বছরের মার্চ মাসে মিসরের প্রশাসনিক বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ে আদালত রায় দিয়েছিলেন—রাষ্ট্রের উচিত ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা, যে মজুরি সরকারি-বেসরকারি সব মজুরি-শ্রমিকের জন্য প্রযোজ্য হবে। এ রায় ‘মজুরি-যুদ্ধ’ সূচনা করেছিল। গবেষকদের তথ্যানুসারে, ২০১০ সালে এমন কোনো দিন যায়নি, যেদিন ‘অন্তত তিনটি বিক্ষোভ’ সংঘটিত হয়নি। আর এদের বেশির ভাগই ছিল শ্রমিক ধর্মঘট।
শিক্ষিত তরুণেরা মোবারকের স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রে থাকলেও এতে শ্রমজীবী জনগণের অবদানকে খাটো করে দেখা হবে ভুল। এবারের আরব বিদ্রোহের সূতিকাগার তিউনিসিয়ায় যেমন, তেমনি মিসরেরও শ্রমজীবী জনগণের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিউনিসিয়ায় শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর ডাকা সাধারণ ধর্মঘট ‘নির্ণায়ক’ ভূমিকা রেখেছে। আর মিসরে মোবারক সরে যেতে সম্মত হওয়ার আগে সারা দেশ পঙ্গু করে দিতে সহায়তা করেছেন পরিবহনশ্রমিকেরা। ১২ ফেব্রুয়ারি মোবারক পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার আগের কয়েক দিন রাজনৈতিক ধর্মঘটের আহ্বান ‘বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল’। জুলাই মাসেও আন্দোলনের উত্তেজনা এখানে দৃশ্যমান। জনগণের প্রতিরোধ তাই ১২ ফেব্রুয়ারিতেই শেষ হয়ে যায়নি। মোবারকের পদত্যাগ আসলে দ্বার খুলে দিয়েছে। সর্বত্র ধর্মঘট চলেছে। পেট্রল, গ্যাস, ইস্পাত, ডাক পরিষেবা—নানা খাতে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ চলেছে। এমনকি কায়রোর পুলিশও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। মোবারকের বিদায়ের মধ্য দিয়ে তাঁর স্বৈরশাসনের সব অবিচার নিয়ে জনরোষ বন্ধ হয়ে যায়নি। এ তো অত্যন্ত স্পষ্ট। আসলে এটা বিপ্লবের নতুন পর্যায় সূচনা করেছিল।
মোবারকের বিদায়-পরবর্তী ঘটনাবলি যে শুধুই পুনরাবৃত্তি নয়, তার স্পষ্টতর ইশারা মেলে শ্রমিকদের দাবিদাওয়ার দিকে দৃষ্টি দিলে। মিসরের মধ্য আকারের নগর, যেমন মাহাল্লা আল-কাউব্রাতে নজর দেওয়া যাক। সামরিক পরিষদ ধর্মঘট নিষিদ্ধের চেষ্টা করার কিছু পরই ‘মিসর’ বস্ত্র কারখানার শ্রমিকেরা কারখানা কম্পাউন্ডে তাহরির স্কয়ারের অনুকরণে তাঁবু খাড়া করেছিলেন; কারখানার দেয়ালে পোস্টার টাঙিয়ে নিজেদের দাবি প্রকাশ করেছিলেন। তাঁদের প্রধান দাবি—দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কোম্পানির পরিচালকের অব্যাহতি। শ্রমিকদের এই কাণ্ডের তাৎপর্য শুধু স্থানীয় গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পরবর্তী সময়ে কোম্পানির পরিচালকদের হটাতে আন্দোলন হয়েছে আরও অনেক কোম্পানিতে। ২০০৮ সালে মজুরি বৃদ্ধি ছিল কেন্দ্রীয় দাবি, এটা এখনো খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে শ্রমিকেরা এখন ন্যূনতম মজুরি এক হাজার ২০০ মিসরীয় পাউন্ড নির্ধারণ করার দাবি করছেন। তাঁরা বাঁচার মতো মজুরি চান। বর্তমানে অনেক শ্রমিককে তাঁদের দাবিকৃত মজুরির এক-চতুর্থাংশ নিয়েই চলতে হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ নিজেদের কোম্পানির ভেতর গণতন্ত্রের সপক্ষে কণ্ঠস্বর জোরালো করার জন্য শ্রমিকদেরও উদ্দীপিত করেছে। মোবারকের দোসরদের কবজা থেকে নিজেদের কারখানা মুক্ত করার লক্ষ্যে শ্রমিকদের আন্দোলন করা থেকে বোঝা যায়, মিসরের বিপ্লব নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে।
বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ ও নিবৃত্ত করার দ্বিমুখী খেলা খেলে সামরিক পরিষদ ঘটনাপ্রবাহ ঘুরিয়ে দিতে চাওয়া সত্ত্বেও জনগণ এগিয়ে চলেছে। তাঁরা আরও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন চান। পশ্চিমা শক্তিগুলোর ঘনিষ্ঠ মোবারক অপসারিত হওয়ার পর মিসরের ওপর থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিতে তারা বিপুল চেষ্টা চালিয়েছে। তাই লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পশ্চিমা জনগণের মনোযোগ মিসরের বিদ্রোহ ও তার সম্ভাব্য র‌্যাডিকেল তাৎপর্য থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়ে উঠল ন্যাটোর অন্যতম লক্ষ্য। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের সংগ্রামের মানে প্রশস্ততর করেছেন মিসরের শ্রমিকেরা। তাঁরা পুনরাবৃত্তিতে আগ্রহী নন। আরব বিপ্লবকে একেবারে নতুন মঞ্চে নিয়ে যাওয়াই তাঁদের প্রত্যাশা।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
 ড. পিটার কাস্টার্স: প্রথম আলোর ইউরোপীয় বিশেষ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.