কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-বাঘের মাসি ও বাঘের গল্প by রণজিৎ বিশ্বাস

আপনার হাতে ওটি কী? : একটি বই। বলতে পারেন গ্রন্থ। : বই ও গ্রন্থের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে? : আছে। পাঠ ও অধ্যয়নের মধ্যে যে পার্থক্য, দেখা ও পর্যবেক্ষণের মধ্যে যে পার্থক্য, বলা যেতে পারে এ তো তেমন এক পার্থক্য।
: আমি যদি আপনাকে বুঝতে পারি, ঘোষণা ও পাঠের মধ্যে যে পার্থক্য, এও অনেকটা তেমন পার্থক্য।
: না, আপনি আমাকে বুঝতে পারেননি, এও অনেকটা তেমন পার্থক্য নয়। ঘোষণা ও পাঠের মধ্যে পার্থক্য অনেক বড়। এত বড় যে সরল সোজা মানুষ তার ধারণাও নিতে পারে না। 'ঘোষণ' ও 'পঠন', দুটি ভিন্ন জিনিস। বহুমাত্রিকভাবে ভিন্ন জিনিস।
: এর কয়েকটি মাত্রার কথা কি বলবেন?
: বলতে পারি। তবে দু-চার-পাঁচটি নয়, সবচেয়ে বড় একটি কথাই শুধু বলব। সব কয়টি কাভার করার সময় পাব না। নষ্টভ্রষ্ট ও বাই চান্স মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটা আর্টিকল আমার হাতে আছে, সেটি শেষ না করে অন্য কাজে আমি মন দিতে পারছি না।
: ঠিক আছে, যতটা সম্ভব ততটাই আপনি বলুন, আমরা নোট করছি।
: নোট আপনাকে বেশিক্ষণ করতে হবে না। আপনি যে আদর্শে বিশ্বাস করেন, জন্মের পর থেকেই তো তাদের আমি চিনি এবং হাড়ে হাড়ে চিনি। আমার কথা আপনার ভালো লাগবে না। তবু শুনুন, এক এক করে বলি। প্রথম পার্থক্য হচ্ছে, কোনো বিশেষ ঘটনার বিশেষ আহ্বানের বা বিশেষ বাস্তবতার ঘোষণা যে কেউ দিতে পারে না, যে কেউ দেওয়ার সাহসও করে না। যে কেউ দিলে মানুষ তা শোনেও না, মানেও না; মানুষ হাসে। কোনো কিছু ঘোষণা করার জন্য, বিশাল কোনো কাজে মানুষকে আহ্বান জানানোর জন্য মানানসই মানুষ লাগে, 'বিফিটিং ক্যারেক্টার' লাগে, 'টাওয়ারিং পার্সোনালিটি'র প্রয়োজন হয়। কিন্তু একটি ঘোষণাপত্র কোনো মহান ব্যক্তির নামে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে যেকোনো অর্ডিনারি মানুষও ভাগ্যক্রমে পাঠ করে ফেলতে পারে। আপনার চেয়ে অর্ডিনারি মানুষ তো পাঠ করতে পারেই, এমনকি আমার চেয়ে অর্ডিনারি মানুষও এই পাঠকর্ম সেরে ফেলতে পারে। তাই বলে যিনি পাঠ করেন, তাঁকে ঘোষকের মর্যাদা দেওয়া যায় না। যাঁরা নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনো মতলববাজিতে তা করার চেষ্টা করেন, মানুষ তাঁদের নিয়ে বেশ হাসাহাসি করে।
: সে হাসাহাসি গায়ে না মাখলেই হলো!
: তা-ই তো হচ্ছে! আপনার চারপাশে দেখুন না, চূড়ান্ত মতলববাজি ও ক্রীড়াশূন্যতায় ডুবতে ডুবতে যাঁরা এসব করছেন, সংখ্যায় কম হলেও এভাবেই তো করে চলেছেন। তাঁরা বুঝতে পারেন না, আমের জায়গা আমড়া কখনো নিতে পারে না। ক্ষতি করার জন্য ঘোগ বাঘের ঘরে লুকিয়ে থাকতে পারে, বাসাও বাঁধতে পারে, কিন্তু বাঘ হয়ে যেতে পারে না; বাঘের মাসি আর বাঘ কখনো এক পাল্লায় উঠতে পারে না, বিড়ালকে টেনেটুনে বাগডাশ বানানো যায়, বাঘ কখনো নয়; বাঘের আগে 'বাঘা' লাগে না; কেউ বলে না 'বাঘা বাঘ', তবে 'বাঘা কুকুর' অনেকেই বলে।
: এক ডাল থেকে আরেক ডালে উঠে অনেক দূর ঘুরে এলাম।
: আমি কী করব! আপনিই তো আমাকে তেমন পথে ডেকে নিলেন। নইলে বই আর গ্রন্থের পার্থক্য নিয়ে আমি তো ভালোই ছিলাম।
: তাতেই আবার ফিরতে চাই। বই আর গ্রন্থ নিয়ে আজকাল বেশ ছোড়াছুড়ি হচ্ছে। ইন ফ্যাক্ট, দেশের সবচেয়ে বড় ও পবিত্র আইনগ্রন্থটিকে কিছু মানুষ বড় অশ্রদ্ধা করছে।
: কিভাবে?
: আপনি কিছু জানেন না বুঝি! তারা এই গ্রন্থটিকে হেলা-অবহেলা আর অবজ্ঞায় ছুড়ে ফেলতে চাইছে। ছুড়ে ফেলতে চাইছে বর্জ্যাধারে। এ কাজে শোল নাচছে, বোয়াল নাচছে, সঙ্গে সঙ্গে মোলাঢেলা আর ক্যাচকিগুঁড়াও নাচছে।
: আপনার অসুবিধা কী! নাচছে কিন্তু একা একা, সঙ্গী জোটাতে পারছে না।
: আপনার অসুবিধা কী? নাচছে তো ওরা মহান সৃষ্টিকর্তার নামে! তিনি মাইন্ড না করলে আপনার অত কথা কিসের?
: এ আবার কেমন মুষলিগাড়লি! বিধাতা কি সব সময় তাঁর আসনে থাকেন নাকি যে মাইন্ড করার অবকাশ পাবেন! তা ছাড়া তাঁকে তো বড় বড় বিষয়ে মনোযোগ ঢালতে হয়। এটি তাঁর জন্য অনেক ছোট বিষয়?
বাকি থাকল, আমার অত কথা কিসের! শুনুন, আমার অত কথা কিসের। আমার কথা হচ্ছে, মতলববাজ ওই ধর্মবাজ ভ্রষ্ট ও নষ্ট লোকেরা বুঝতে পারছে না, যে গ্রন্থটি ওরা বর্জ্যাধারে ছুড়ে ফেলতে চাইছে, তাতে বিধাতার নাম আছে, স্রষ্টার নাম আছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মহা সৃষ্টিকর্তার নাম আছে। তারা বুঝতে পারছে না, গ্রন্থ ছোড়ার সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টিকর্তাকেও তারা ছুড়ে ফেলছে।
: আর কী বুঝতে পারছে না তারা?
: তারা বুঝতে পারছে না বিধাতা শুধু তাদের সৃষ্টিকর্তা নন; তিনি সব বিশ্বাসের, সব জন্মপরিচয় ও উপাস্যপরিচয়ের মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তিনি সব জীবের, সব কীটের ও সব তৃণের স্রষ্টা। তারা বুঝতে পারে না, অসাম্প্রদায়িক বিধাতাকে তারা সাম্প্রদায়িক করে তুলছে। এমন করতে গিয়ে তারা মানুষকেও হাসাচ্ছে, হাসাচ্ছে বিধাতাকেও। মানুষ হাসে হাসুক, বিধাতা কেন হাসবেন! নিরপেক্ষতার সঙ্গে সব কাজ করার জন্য তাঁকে তো বিপুলভাবে গম্ভীর থাকতে হবে! আমরা বা আপনারা জেনেশুনে তো বিধাতার কোনো ক্ষতি করতে পারি না! আমরা তো তাঁর ইমেজ নষ্ট করতে পারি না!
লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.