রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ড-মৃতদেহ আর রক্তাক্ত করবেন না by জ. ই. মামুন

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির বীভৎস হত্যাকাণ্ড কেবল আমাকে বা সাংবাদিক সমাজকে নয়, স্তম্ভিত করেছে গোটা দেশের মানুষকে। এমনকি প্রবাসে থাকা বাংলাদেশিরাও তাঁদের শোক, সহানুভূতি ও ক্ষোভ জানাচ্ছেন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা গণমাধ্যমে।


সহকর্মী হিসেবে আমরা এখন রুনি-সাগরের জন্য অশ্রু বিসর্জন করছি, শোকসভা করছি, বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করছি, টক শো করছি টিভিতে, পত্রিকায় লিখছি। আবার ওঁদের একমাত্র শিশুসন্তান মেঘের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি কিংবা অপেক্ষা করছি, পুলিশ কখন বের করবে আসল হত্যাকারী। কিন্তু এমন সময়ে আমাদের আরও বেশি অশ্রুসিক্ত করছে, আমাদের কিছু সংবাদমাধ্যমের, সংবাদকর্মীর অপেশাদার এবং বাস্তবতাবিবর্জিত সংবাদ পরিবেশন। নিহত রুনির মা, ভাই, সহকর্মীসহ বিবেকবান, সুস্থ রুচির মানুষ দেখছে গুটিকতক সংবাদকর্মীর ওই দায়িত্বজ্ঞানহীন সাংবাদিকতা আর আকাশে-বাতাসে বানোয়াট গল্প ছড়িয়ে দিয়ে তারা আরও বেশি রক্তাক্ত করছে খুন হয়ে যাওয়া রুনি-সাগরের সেই রক্তাক্ত মৃতদেহকে।
সাগর-রুনি খুন হয়েছেন শুক্রবার শেষ রাত বা শনিবার প্রত্যুষে। আগের দিন দুজনই অফিস করেছেন নিজ নিজ কর্মস্থলে। সাগর মাছরাঙা টিভিতে সেদিন রাতের পালায় কাজ করার কারণে বাড়ি ফিরেছেন মধ্যরাতের পর। আর রুনি ফিরেছেন বিকেলে, এটিএন বাংলার অফিস থেকে। দুজনই সেদিন তাঁদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে, স্বাভাবিকভাবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এঁদের দুজনকে চিনি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। সাগর-রুনি দুজনই অসম্ভব সদালাপি, বিনয়ী ও প্রাণোচ্ছল। কিন্তু বাস্তবতার নির্মম পরিহাসে ওঁদের এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তাও আবার দুজনকে একই সঙ্গে। আর এখন শুনছি, দেখছি রুনির চরিত্র হননের নানা অপচেষ্টা।
যেকোনো মামলার তদন্তের দায়িত্বে সরকারের পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা বিভাগ আছে। আমরা বিশ্বাস করি, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর এই ঘটনা নিয়েও তারা জোর তদন্ত- অনুসন্ধান চালাচ্ছে। আশা করি, খুব শিগগির তারা খুনিদের চিহ্নিত করে দেশবাসীর সামনে হাজির করতেও পারবে। যতক্ষণ পর্যন্ত খুনিরা শনাক্ত না হয়, যতক্ষণ তাদের আইনের আওতায় আনা না যায়, ততক্ষণ আমাদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে বলেই আমি মনে করি, তবে অপেক্ষা করা মানে বসে থাকা নয়। আমরা গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে পুলিশের ওপর, সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে পারি আমাদের লেখনীর মাধ্যমে, আমরা মানববন্ধন বা সমাবেশসহ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদও জানাতে পারি। যা পারি না, তা হচ্ছে—মৃত দুই সাংবাদিকের ব্যক্তিগত চরিত্র হননের চেষ্টা করে মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে প্রবাহিত করতে কিংবা এই হত্যাকাণ্ডের কারণে রুনি- সাগরের প্রতি সাধারণ মানুষের যে সহানুভূতি তৈরি হয়েছে তা নষ্ট করতে। কিন্তু অত্যন্ত উদ্বেগ ও দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি যে সুচারুভাবে সে কাজটিই শুরু করেছেন কেউ কেউ।
পত্রিকা ও টেলিভিশনের রিপোর্টিং এবং সংবাদ সম্পাদনার কাজের অভিজ্ঞতা ও সামান্য লেখাপড়ার জ্ঞান থেকে আমি এটুকু শিখেছি যে কোনো সংবাদ পরিবেশনের আগে সাংবাদিককে অবশ্যই তার সত্যতা এবং বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হতে হয়। কোনো সংবাদের সত্যতা নিয়ে সামান্যতম সন্দেহ থাকলেও তা প্রচার বা প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু রুনি-সাগরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমরা দেখছি ভিন্ন চিত্র।
সবচেয়ে দুঃখের কথা, নিহত রুনির চরিত্রে কালিমা লেপনেও পিছপা হচ্ছেন না অনেকে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোনো ঘটনায় যদি কোনো মেয়ে জড়িত থাকেন, তাঁর চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করতে পারলে বিষয়টি অনেক রসালো হয়। তাই সাংবাদিকতার নৈতিক দায়বদ্ধতা আবারও প্রশ্নবিদ্ধ বাংলাদেশে। রুনি-সাগরের সহকর্মী-বন্ধু হিসেবে পুলিশ বা প্রশাসনের কাছে আমার বক্তব্য খুব স্পষ্ট, এই হত্যাকাণ্ডে যে বা যারাই জড়িত থাকুক, তাদের চিহ্নিত করুন, গণমাধ্যমের সামনে প্রকাশ করুন এবং সুষ্ঠু বিচারের মুখোমুখি করুন। আর সাংবাদিক বন্ধু-সহকর্মীদের কাছে আবেদন, আপনারা সাংবাদিকতার প্রাথমিক শর্ত সত্যনিষ্ঠ থাকুন, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করুন। গুজব ছড়াবেন না, কাউকে ছোট করতে গিয়ে দয়া করে নিজের পেশাকে, পেশার মহত্ত্বকে ছোট করবেন না।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা দরকার, ধারণা করি, রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ড চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে বা হবে। এই মামলা নিয়ে সাধারণ মানুষের যেমন আগ্রহ, তেমনি বা তার চেয়ে বেশি আগ্রহ সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের। তাই তাঁদের হত্যা মামলার সামান্যতম অগ্রগতিও গণমাধ্যমকে জানাতে আমি বিনীত অনুরোধ করব। প্রতিদিন পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও একটি সংবাদ সম্মেলন করে সেদিনের অগ্রগতি জানাতে পারে পুলিশ সদর দপ্তর বা পুলিশের গণযোগাযোগ বিভাগ। আর এ কাজটি নিয়মিত করতে পারলে গুজবের ডালপালা ছোট হয়ে আসবে। আরেকটি কথা বলে এই লেখা শেষ করব, সেটি মেঘের প্রসঙ্গ। রুনি-সাগরের একমাত্র সন্তান ছয় বছরের মেঘ সেই রাতের নৃশংসতা নিজের চোখে দেখেছে কি না, আমরা এখনো সত্যিকার অর্থে জানি না। হ্যতাকাণ্ড না দেখলেও সে দেখেছে তার মা-বাবার রক্তাক্ত মৃতদেহ। এতটুকু শিশুর মনে সেই দৃশ্য কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে, তা হয়তো মনোবিজ্ঞানীরা ভালো বলতে পারবেন। তবে সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা এইটুকু বুঝি যে এমন করুণ ও নির্মম ঘটনা সে বারবার মনে করতে চাইবে না। সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে অনুরোধ, সাক্ষাৎকারের নামে মেঘকে বারবার আপনারা সেই রক্তাক্ত স্মৃতি স্মরণ করাবেন না, ওকে সুস্থ হতে দিন। তথ্য সংগ্রহের নামে প্রতিদিন ওর ছোট্ট হূদয়টিকে রক্তাক্ত করবেন না।
জ. ই. মামুন: বার্তাপ্রধান, এটিএন বাংলা।

No comments

Powered by Blogger.