কৃষি-পাটকাহিনি by সাইফুদ্দীন চৌধুরী

জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত দুটি সংবাদ আমাকে দারুণভাবে আন্দোলিত করেছে। সংবাদ দুটি দেশের পাটসম্পদ-সম্পর্কিত। একটি ‘সৈয়দপুুরে নতুন পাটকল উদ্বোধন’, অন্যটি ‘পাট খাতে নানামুখী সমস্যা ও সমাধানবিষয়ক কর্মশালা’।


একের পর এক যখন দেশে পাটকল বন্ধ হচ্ছে, সে জায়গায় নতুন পাটকল স্থাপনের কথা জেনে অবাক হতে হয়েছে বৈকি! দেশে পাট খাত নিয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাহলে দেশের অবহেলিত এই পাট খাতে কি সুদিন আসছে!
পাট খাত বা পাটশিল্পের ঐতিহ্য তো অনেক পুরোনো। দেশে পাটচাষের ইতিহাস তো অনেক দিনের। প্রাকৃত পৈঙ্গল নামে প্রাচীন সাহিত্যে আছে, সে কালে এ দেশের পুণ্যবান লোকেরা মৌরলা মাছ এবং ‘নালিচ’ অর্থাৎ পাটের কচিপাতার শাক খেত। মধ্যযুগের কবি, দক্ষিণ বঙ্গের বিজয়গুপ্ত মনসামঙ্গল-এ লিখেছেন:
তার পাছে বাওয়াইল ডিঙ্গা নামে টিয়া ঠুটি,
সেই নায় ভরে সাধু পাট আর ভুটি।
অনেক ঐতিহাসিক সে কালের পাট আর পাটজাত বস্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন তাঁদের লেখায়। এ দেশ থেকে পাট ও পাটজাত সামগ্রী বিদেশে রপ্তানি হতো। আঠারো শতকের শেষের দিকে পাটের প্রতি ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, যখন ড. রোক্স বার্গ ইংল্যান্ডে প্রথম পাটের চালান পাঠান। পর্যটক টেভারনিয়ারের লেখা থেকে জানা যায়, আঠারো শতকের ওই সময়ে এ দেশ থেকে নিয়মিতভাবে ইউরোপে পাট রপ্তানি হতো। এক হিসাব থেকে দেখা গেছে, ১৮২৫ সাল থেকে ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত গড়ে প্রতিবছর ১১ হাজার ৪০০ হন্দর পাট এ দেশ থেকে রপ্তানি করা হয়েছে। ইংল্যান্ডের শনের সুতা পাকানের যন্ত্রে পাটের সুতা পাকানোর কাজ সফলভাবে সম্পাদন করা শুরু হয়।
উপমহাদেশের প্রথম পাটকল স্থাপন করেন লর্ড অকল্যান্ড। তিনি ১৮৫৫ সালে কলকাতার উপকণ্ঠে হুগলী নদীর তীরে রিষড়ায় স্থাপিত পাটকলটি নিয়ে আসেন ইংল্যান্ডের ডান্ডি থেকে। পূর্ববাংলা পাটের প্রধান উৎপাদন অঞ্চল হলেও অজ্ঞাত কারণে কলকাতায় পাটকল বসানো হয়। এই কলে সুতলি, পাটের সুতা, দড়ি ও সাধারণের পরিধান উপযোগী মোটা কাপড় তৈরি শুরু হয়। ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত উপমহাদেশে মাত্র চারটি পাটকল স্থাপন করা হয়। অপরদিকে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত ১১০টি চটকলে পাটজাত সামগ্রী প্রস্তুত হতে থাকে। কলকাতা ও ডান্ডিতে পাটশিল্প কেন্দ্রীভূত হলো, অথচ পাটের জন্মস্থান পূর্ববাংলায় একটিও পাটকল স্থাপিত হলো না।
১৯২৯ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময় পাটজাত পণ্যের চাহিদা বিশ্বজুড়ে পড়ে যাওয়ায় পাটজাত শিল্প গুরুতর হুমকির সম্মুখীন হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই শিল্পের সামান্য কিছু পরিবর্তন ঘটলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির সময় সব কটি পাটকল পড়ে ভারতের অংশে, অথচ পাট উৎপাদন জেলাগুলো ছিল পূর্ব বাংলায়। স্বাভাবিকভাবে এ সময় পূর্ববঙ্গে পাটকল না থাকায় কাঁচা পাট বাজারজাত করার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয় উৎপাদক ও বিক্রেতাদের। তবে দেশে দ্রুতই বেশ কটি পাটকল স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি মালিকানাধীন আদমজি জুটমিলস।
পূর্ববঙ্গে প্রতিষ্ঠিত পাটকলের ৬৮ শতাংশ মালিক ছিল অবাঙালি পাকিস্তানিরা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পাটকলগুলো অব্যবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। দক্ষ শ্রমিকের অভাব, ট্রেড ইউনিয়নের অসম ক্ষমতা প্রদর্শন, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, খুচরা যন্ত্রাংশের অভাব, শ্রমিক অসন্তোষ, উৎপাদনের অপচয় পাটশিল্পকে বিপর্যস্ত করে তোলে। তবু, পরবর্তী সময় এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সত্তরের দশকে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত আসত পাট খাত থেকে। বর্তমানে যা তিন থেকে চার শতাংশে নেমে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশি ও আন্তর্জাতিক বাজারে এখন পাটের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। এই বাজার পেতে হলে আমাদের দেশের পাটের বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে হবে। তাঁরা বলছেন, বিশ্ব বাজারের চাহিদা পূরণ করতে হলে বিদ্যমান আঁশের চেয়ে নরম আঁশের পাট তৈরি করতে হবে। জরুরি প্রয়োজন সে ধরনের পাটের বীজ উদ্ভাবন করে উৎপাদক কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা। তাঁরা আরও বলেছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে পাট উৎপন্ন হয় তার আঁশ মোটা, সেই মোটা আঁশ দিয়ে উন্নতমানের পাটজাত সামগ্রী উৎপাদন কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত সেভাবেই এগিয়ে গিয়ে বিশ্ববাজার মোকাবিলা করছে। বাংলাদেশকেও তা অনুসরণ করতে হবে। বন্ধ পাটকলসমূহ চালুর বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষকদের ‘রোটেটরি’ পদ্ধতিতে অন্য ফসলের সঙ্গে পাটচাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে, কৃষকেরা যেন পাটের ন্যায্য মূল্য পান। ‘সোনালি আঁশ’ হিসেবে পাটকে পেতে চাইলে, এর হূতগৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে, এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। তবে এর সবকিছু নির্ভর করছে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর।
সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক ও অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.