রিক্ত হাতে চলে গেলেন তাঁরা by আবেদ খান

এক. প্রচণ্ড জোর খাটিয়ে ইচ্ছেটাকে দমন করেছি। শহীদ মিনারে বাংলাদেশের পপগুরু মুক্তিযোদ্ধা আজম খানের শবাধারে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-পেশাজীবী অঙ্গনের বিদগ্ধজনরা যখন শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করছিলেন, তখন আমি ওখানে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে সত্যিই প্রবলভাবে পরাস্ত করেছি।
ভেবেছি, আর কত যাব শহীদ মিনারে! এই আমরাই দাঁড়াই মিছিলে রজনীগন্ধার বৃন্ত হাতে, তারপর এক দিন এই আমাদেরই কেউ কেউ শুয়ে থাকি শ্বেতবস্ত্রমণ্ডিত হয়ে কফিনের ভেতরে। যতবার গেছি ইদানীং ততবার আমি বিপন্ন দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করেছি মিছিলের প্রতিটি মুখ। এর পর কার শোয়ার পালা? সামনে মাইক্রোফোনে ঘোষকের কণ্ঠে শ্রদ্ধা নিবেদনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম উচ্চারিত হবে, পেছনে থাকবে কালো কাপড়ের ওপরে লেখা তাঁর নাম, যিনি শুয়ে আছেন সাষ্টাঙ্গে ওই কফিনের মধ্যে এবং কিছুই জানছেন না, বুঝছেন না কী হচ্ছে সেখানে। কার ডাক পড়বে ওখানে আজম খানের পর? এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কাটিয়েছি বিষণ্ন সময়। টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখিনি, রেডিওতে কান পাতিনি, গানের সিডি বাজাইনি। দুপুরের পর থেকে ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দি রেখে জানালা দিয়ে আকাশের নীল দেখেছি, মেঘকে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে দেখেছি, বিকেলের শেষ রোদটুকু এক চুমুকে নিঃশেষ করে তৃপ্ত রাতকে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি।
দুই.
আমার এই বিমর্ষ প্রহরে অবগাহন করার কারণ দুটি। এক, আজম খানের অকাল প্রয়াণ এবং দুই, আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ-অগ্রজ বন্ধু দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াত হওয়ার সংবাদ। আজম খান আমার পরিচিত, তবে ঘনিষ্ঠ নন। সত্তরের গোড়ায় স্বাধীনতার ঠিক পরপরই সে সময়কার তরুণ ও যুবসমাজের একাংশের ভেতরে যে অস্থির অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, ঠিক সে সময়ই আমি আজম খানকে চিনতে শুরু করি। আমাদের মধ্যে তখন হেমন্ত, মান্না দে, শ্যামল, মানবেন্দ্র, সতীনাথ, সন্ধ্যা, প্রতিমার বিশাল ছায়া। সত্যি বলতে কী ষাটের দশকের পাশ্চাত্য দুনিয়ার সেই অ্যাংরি ইয়াংম্যানদের সংগীতধারা এই উপমহাদেশে যখন কড়া নাড়তে শুরু করে, আমার আচ্ছন্ন মন সেটাকে তখন গ্রহণ করতে পারেনি। কাজেই আজম খান যখন যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ওই ধারার সূচনা করলেন, আমি তখন মনে মনে বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম। অবশ্য আমার জগৎ যেহেতু সংগীতের নয়, সেহেতু সেই বিরক্তিতে কারো কিছু যায়-আসেনি। কিন্তু স্রোত ও সময় তখন আজম খানদের অনুকূলে। বিশাল তরুণ প্রজন্ম আজম খানকে তাদের মাথার মণিতে রূপান্তরিত করেছে, বসিয়েছে তাদের উদ্দাম ভালোবাসা এবং প্রাণোচ্ছলতার সংগীতভুবনের গুরুর আসনে। আশির দশকে টেলিভিশনে আনন্দমেলা অনুষ্ঠানের সুবাদে পিলু মমতাজ, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদরা এসেছিলেন। ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ আমার পূর্বপরিচিত। পিলু নন। কথায় কথায় আজম খানের প্রসঙ্গ উঠল। ওঠালেন ফিরোজ সাঁই-ই। বললেন তাঁর প্রসংগে প্রশংসাসূচক কিছু কথা। বাংলাদেশের জন্য যিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন অস্ত্র হাতে, তাঁর কাছ থেকে পাশ্চাত্যের পপ শুনব কেন, শুনব বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ গান_এটাই ছিল আমার কথা। কিন্তু ফিরোজ সাঁই মিষ্টি হেসে আমাকে যুক্তি দিয়ে কাবু করে ফেললেন।
আজম খানের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটল আরো বেশ কয়েক বছর পর। খুবই সাধারণভাবে। সম্ভবত কোনো এক চায়নিজ রেস্তোরাঁয়। কারো কোনো অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন বোধ হয়। আমি যাঁদের সঙ্গে ওই রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলাম, দেখি তাঁদের কয়েকজনের মধ্যে উত্তেজনা, ফিসফিস গুঞ্জন। তাঁদের এই উত্তেজনার কারণ একজনই_লম্বা-ঢ্যাঙ্গা হাসি হাসি মুখের এক মানুষ, সাধারণভাবে গল্পগুজব করছেন, আজম খান। একজন বললেন, চলুন, পরিচিত হই। সংকোচ এবং ইচ্ছে, দুটোই হচ্ছিল। সামনে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম। তিনি সলজ্জভাবে মাথা নাড়লেন। মনে হয়, বিব্রতও বোধ করছিলেন এ রকম অযাচিত উপস্থিতিতে। আমিও কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সেলিব্রিটিরা সাধারণত এ রকম অবস্থায় বিব্রত হন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সন্তোষ লাভ করেন। মনে হলো, আজম খান সে ধাঁচেরই নন, একদম সাধারণ এবং পাশের বাড়ির একজন মানুষের মতো। চলে এলাম। এটাকে নিছক দেখা হওয়া বলা যায়, পরিচয় বলাটা সমীচীন নয়। কিন্তু পরিচয় বললাম এই কারণে যে এর অন্তত চার-পাঁচ বছর পর ফকিরাপুলে বিআরটিসি বাস ডিপোর ওখানে যখন তাঁর সঙ্গে দেখা হলো, তিনি বহুদিনের পরিচিত মানুষের মতো আমাকে হাত তুলে সম্ভাষণ জানালেন। অবাক হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কি আমাকে চিনেছেন? তিনি আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, চিনব না কেন, আপনাকে তো টিভিতে দেখেছি অনেকবার, আর কয়েক বছর আগে তো আপনার সঙ্গে পরিচয়ই হয়েছিল। আমাকে অবাক করে তিনি সেই প্রথম দেখার স্মৃতিটি অবিকল বলে দিলেন।
আমি যখন যুগান্তরের সম্পাদকের দায়িত্বে তখন আজম আমাদের অফিসে এসেছেন একাধিকবার। ওই সময় বিকেলবেলায় আমি অফিস থেকে বেরিয়ে কখনো নটর ডেম কলেজের মাঠ, কখনো টিঅ্যান্ডটি কলোনির মাঠে ঘণ্টাখানেক হাঁটতাম। টিঅ্যান্ডটি কলোনির মাঠে দুই-চার দিন তাঁকে হাঁটার সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি। পরিচয় ওইটুকুতেই সীমাবদ্ধ বটে, তবে তাঁর ব্যাপারে আমার আবেগ গভীরভাবে সঞ্চারিত হয়েছে যখন দেখেছি, এত নামি একজন শিল্পী কী শিশুর সারল্য নিয়ে নিরাভরণ জীবনযাপন করেন! নিজে প্রকাশ না করতে চাইলেও অজান্তে তাঁর কথা থেকে যেটুকু শুনেছি, তাতে মনে হয়েছে, তাঁকে ব্যবহার করেছে অনেকে, কিন্তু বিনিময়ে সামান্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশটুকুও করেনি কেউ কেউ। দারিদ্র্য তাঁর অনুযোগের বিষয় ছিল না কখনো। সংগীতের মতো ওটাকেও তিনি তাঁর জীবনের অপরিহার্য অংশ করেছেন সব সময়। গানের ভেতর দিয়ে সাধারণ মানুষের বেদনাকে তুলে ধরেছেন, দেশকে তুলে ধরেছেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবিচল বিশ্বাসের কথা তুলে ধরেছেন। ভাবতে কষ্ট হয়, আজীবনবঞ্চিত এই জাতশিল্পী চলি্লশ বছরেও কোনো জাতীয় স্বীকৃতি পাননি।
তিন.
চলি্লশ বছর ধরে অপেক্ষা করে করে একসময় ক্লান্ত হয়ে চলে গেলেন আরেকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের নাগরিক নন তিনি। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অপরিসীম। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। একাত্তর সালে আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ পরিক্রমা শোনেননি এমন বাঙালির সংখ্যা তখন খুব কমই ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে শত্রুকবলিত বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ গোপনে রেডিওর নব ঘুরিয়ে উৎকর্ণ হয়ে শুনত মেঘমন্দ্রিত কণ্ঠস্বরের অভয়বাণী। যিনি অসাধারণ সংবাদপরিক্রমা লিখতেন, সেই প্রণবেশ সেন গত হয়েছেন কয়েক বছর আগে, আর, যিনি পাঠ করতেন, সেই দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেলেন দিন পাঁচেক আগে। প্রণবেশ-দেবদুলাল জুটি মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতরে যে কী প্রবল উদ্দীপনা ও জাগরণ সৃষ্টি করেছিল, তা একালের প্রজন্ম কল্পনাও করতে পারবে না।
আজ থেকে ঠিক চলি্লশ বছর আগে মে মাসের সম্ভবত শেষদিকে আমি কলকাতার আকাশবাণী ভবনে পেঁৗছেছিলাম। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছিলাম কিভাবে পাকিস্তানি বাহিনী কামান দেগে উড়িয়ে দিয়েছে ইত্তেফাক ভবন। সাংবাদিকের মুখ থেকে নরমেধযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলার প্রত্যক্ষ বিবরণ বিশ্বব্যাপী সেই প্রথম প্রচার হয় বিখ্যাত সাংবাদিক উপেন তরফদারের কল্যাণে এবং সেটা তখন ভারতের সব বেতার কেন্দ্র থেকে পুনঃ পুনঃ প্রচার হতে থাকে। উপেন তরফদারের বন্ধু ও সহকর্মী প্রণবেশ সেন ও দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সুবাদে পরিচয় ঘটল। আকাশবাণী থেকে আমার একটি সাপ্তাহিক কথিকা প্রচারের দায়িত্ব জুটল। কথিকার শিরোনাম 'জবাব দাও'। সেই কাজে সপ্তাহে একটা নির্দিষ্ট দিনে হাকিমপুরের ক্যাম্প থেকে কলকাতার আকাশবাণী ভবনে যেতে হতো। পরিচয় ক্রমেই গাঢ় হলো, ঘনিষ্ঠতা একসময় অন্তরঙ্গতায় পরিণত হলো। 'আপনি' সম্বোধন নেমে এল 'তুমি'তে। আকাশবাণী ভবনের ছাদে সন্ধ্যায় আমাদের চারজনের অনেক আলোচনা, গল্পগুজব, সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করা সময় এখন আবার আমাকে স্মৃতিকাতর করে তুলছে, বিশেষ করে, দেবুদার চলে যাওয়ার পর। একাত্তরের ভূমিকার জন্য দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভারত সরকার সম্মাননা দিয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা সেটা পারলাম না। দেবদুলালকে বাহাত্তরে বঙ্গবন্ধু সম্মান দিয়েছিলেন ভারত থেকে আগত শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর পর দীর্ঘকাল ধরে তিনি বাংলাদেশে অপাঙ্ক্তেয়ই থেকে গেছেন। আর, প্রণবেশ সেন এই পাবনার সন্তান হয়েও তো বাংলাদেশে আসতেই পারলেন না। পারলেন না দেবুদাও। ২০০৬-এর দিকে সম্ভবত দেবদুলাল একবার ঢাকায় এসেছিলেন, তাঁকে নিয়ে এসেছিলাম যুগান্তর অফিসে, আমি ওই পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালে। তারপর আর তাঁর আসা হলো না। কলকাতায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে তাঁর সাদার্ন এভিনিউর বাড়িতে দেখা করেছি, দেখা হয়েছিল কলকাতার নন্দনে_সেখানেও সময় কাটিয়েছি পুরনো দিনের স্মৃতিচারণা করে।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সম্মাননা একবার দেওয়া হয়েছিল বটে বেগম জেবুন্নেছা-কাজী মাহবুবুল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল কলকাতায়, সেটাও সম্ভবত নন্দনে। সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল কবি অন্নদাশঙ্কর রায়, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণবেশ সেন, উপেন তরফদার ও দীপেশ ভৌমিককে। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় ছাড়া বাকি চারজনই আকাশবাণী কলকাতার। তাঁরা আমার সে সময়কার একান্ত আপন। সম্মাননা দেওয়া হবে_এই সংবাদটি যখন প্রণবেশ সেনকে জানানো হয়, তখন তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাড়ি মাথায় করে বলেছিলেন তাঁর স্ত্রীকে_'তোমাকে বলেছি না, বাংলাদেশ আমাকে ভুলতে পারে না, ওরা আমাদের ডাকবেই।'
এবার বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো জাতীয়ভাবে সম্মাননা দেওয়ার আয়োজন করা হয়েছে সেই বিদেশি নাগরিকদের, যাঁরা একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। সম্ভবত দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম সেই তালিকায় আছে। যদি প্রণবেশ সেন, উপেন তরফদার, দীপেশ ভৌমিক, সরল গুহের নাম যুক্ত হতো তালিকায়, তাহলে ভালো হতো। আমি তো ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছি সে সময় তাঁদেরকে। কী নিঃস্বার্থ এবং একনিষ্ঠ ভূমিকা ছিল! তাঁদের মধ্যে জীবিত আছেন শুধু উপেন তরফদার আর দীপেশ ভৌমিক। সরকারের ভাবনার জন্য রাখছি প্রস্তাবটি। প্রস্তাব রাখছি আজম খানকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করার জন্য, যা তাঁর প্রাপ্য ছিল অনেক আগে থেকেই।

No comments

Powered by Blogger.