সবুজ বেষ্টনীর কৃষ্ণ স্বজন by শেখ রোকন

নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী পরিবেশবাদী নেত্রী অধ্যাপক ড. ওয়ানগারি মাথাই ক্যান্সার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তার নিজের গড়া সংগঠন 'গ্রিন বেল্ট মুভমেন্ট'-এর পক্ষ থেকে যদিও দাবি করা হচ্ছে, আবেগের ঊধর্ে্ব উঠে দেখলে ৭১ বছর বয়সের মৃত্যুকে 'অকাল' বলা কঠিন।


অবশ্য এটা অস্বীকার করা যাবে না যে ওয়ানগারি মাথাইয়ের আরও বেশিদিন বেঁচে থাকা প্রয়োজনীয় ছিল। তার নিজের জন্য না যতখানি, এর চেয়ে অনেক বেশি আমাদের সামষ্টিক স্বার্থেই। ক্রমে বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়া এই পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই ওয়ানগারি মাথাইয়ের মতো মানুষের বেঁচে থাকতে হবে।
কিছু মানুষের লোভ ও অতিমুনাফার মাসুল দিতে গিয়ে দিনে দিনে ধূসর হতে থাকা এই সবুজ পৃথিবীকে নতুন করে সাজানোর স্বপ্ন দেখতেন ওয়ানগারি মাথাই। তার একটি বই রয়েছে_ রিপ্লেনশিং দ্য আর্থ। নতুন পৃথিবী গড়ার জন্য তার ভাবনা-চিন্তার সংকলন। কেবল চিন্তা নয়, তৎপরতায় তিনি ছিলেন অনন্য। কেনিয়ার মতো সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে থাকা একটি দেশে ওয়ানগারি এক কার্যকর বৃক্ষরোপণ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ৩০ হাজার গ্রামীণ নারীকে, যাদের কাজ ছিল মূলত প্রাকৃতিক বন থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করা, তিনি গাছ লাগানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। কেনিয়ায় বন উজাড়িকরণের অন্যতম দায়ী হিসেবে যাদের চিহ্নিত করা হয়, তাদেরকেই লাগিয়েছিলেন বন সৃজনের কাছে। সত্তরের দশকে তিনি যখন এই আন্দোলন শুরু করেন, কেনিয়ায় তাকে 'পাগলী' বলা লোকের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে এসে স্পষ্ট হয়ে যায় যে তিনি অসাধ্য সাধনের পথে অনেক দূর এগিয়েছেন। এরপর দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে স্বীকৃতি আসতে থাকে। আর ২০০৪ সালে মূলত সবুজীকরণে অবদানের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারই তার হাতে এসে ধরা দেয়।
পরিবেশ আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী একটি অসুবিধা হচ্ছে তারা যে জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাণপাত করেন, তাদের দিক থেকে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন সামান্যই পান। এর মূলে রয়েছে এই ভ্রান্তি_ পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিত্বরা রাজনৈতিকভাবে 'নিরপেক্ষ' থাকবেন। জার্মানির গ্রিন পার্টি ছাড়া পরিবেশবাদীরা বিশ্বের আর কোথাও রাজনৈতিকভাবে সুবিধা লাভ করতে পারেননি। অথচ পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি গুরুতরভাবে রাজনৈতিক ইস্যু। বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক, রাজনৈতিক শক্তিকে তত্ত্বে ও ময়দানে মোকাবেলা না করে কি বন কিংবা নদী সুরক্ষা সম্ভব? ওয়ানগারি মাথাইয়ের সাফল্য হচ্ছে, তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থেকেই পরিবেশ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরিবেশ আন্দোলনের আরেকটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, গয়রহ বিরোধিতার পথে হাঁটা। ওয়ানগারি মাথাই সরকারের মন্ত্রিত্ব রেখেই পরিবেশ আন্দোলন করেছেন, নোবেলও জিতেছেন। ব্যক্তিগত বিভিন্ন বাধা ও বিপর্যয় মেনে নিয়েও তিনি যেভাবে প্রকৃতি সুরক্ষার প্রশ্নে অনড় থেকেছেন, তাও যথেষ্ট শিক্ষণীয়।
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের সঙ্গে ওয়ানগারি মাথাইয়ের যোগসূত্র খুবই ক্ষীণ। বন উজাড়িকরণ কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে লেখালেখি বা বক্তৃতার সময় প্রাসঙ্গিকভাবে আরও কিছু দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করা ছাড়া আলাদা কিছু চিহ্নিত করা কঠিন। আমাদের দেশের নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো কয়েকজনের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত জানাশোনা ছিল, এর বেশি কিছু নয়। মিসেস মাথাই বরং ভারতের সঙ্গে নানাভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ২০০৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী প্রাইজও পেয়েছেন।
তারপরও ওয়ানগারি মাথাইয়ের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশহানিজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন বাংলাদেশের জন্য স্বজন হারানোর বেদনাই সৃষ্টি করে।
skrokon@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.