শ্রদ্ধাঞ্জলি-দ্বিতীয় অজিত রায় আর জন্মাবে না by কামাল লোহানী

প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক পথিকৃৎ অজিত রায় আকস্মিকভাবে চলে গেলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। ফুসফুসের ক্যানসারের জন্য তাঁর দেহে এর আগে দুবার অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছিল। এবারে অসুস্থ হওয়ার পর যখন তাঁকে বারডেমের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে নেওয়া হয়েছিল, তখন আবারও তাঁর ফুসফুসে ক্যানসারের প্রচ্ছন্ন ছায়া দেখা


যায়। বোঝা যায়, জটিলতা বেড়ে গেছে। এরপর ক্যানসার বিশেষজ্ঞের খোঁজ করা হয়। বারডেম থেকেও চেষ্টা করা হয়েছে; ব্যক্তিগতভাবে আমরাও চেষ্টা করেছি। গতকাল (শনিবার) পর্যন্ত ক্যানসার বিশেষজ্ঞ খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজ (রোববার) সকালে যখন তাঁর ছেলে ক্যানসার হাসপাতালের প্রধান অনকোলজিস্ট পারভীন শাহীদা আক্তারের নাম জানাল, তখন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলো। তিনি ওই মুহূর্তে প্রচণ্ড ব্যস্ত ছিলেন। তিনি অন্য দুজন ক্যানসার বিশেষজ্ঞের নাম দিয়ে যোগাযোগ করতে বললেন। কিন্তু তাতে ফল পাওয়া গেল না। আমি আবার পারভীন শাহীদা আক্তারকে জানালাম, অজিত রায়ের ছেলে সঙ্গী কেস স্টাডিসহ ফাইল নিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। পারভীন শাহীদা আক্তার দুপুরের আগে নিজে থেকেই বারডেমে যান এবং দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আমাকে ফোন করেন। তিনি জানান, অজিত রায়কে বাঁচানো অসম্ভব। তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার মতো শক্তি নেই। এ অবস্থায় চিকিৎসার কোনো সুযোগ নেই। এর কিছুক্ষণ পরই অজিত রায়ের লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়।
অজিত রায় আমাদের দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তানবিরোধী যে রাজনৈতিক সংগ্রাম ছিল, তার সহায়ক শক্তি হিসেবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক ছিলেন অজিত রায়। একজন তুখোড় সংগ্রামী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন তিনি। আদর্শগতভাবে, বিশ্বাসের দিক থেকে তিনি ছিলেন মুক্তিসংগ্রামী। ষাটের দশক থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁর রয়েছে অবিস্মরণীয় ভূমিকা। তিনি ছিলেন তুলনাহীন এক ব্যক্তিত্ব।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পল্টন ময়দানে, শহীদ মিনারে ও বিভিন্ন জায়গায় তিনি গান গেয়ে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সহায়তা করেছেন। ইঙ্গ-মার্কিনবিরোধী আন্দোলনে ভিয়েতনামের পক্ষে, বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে গান গেয়ে জনমত সংগ্রহ করেছেন।
মনে আছে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রধান সুরকার ও শিল্পী হিসেবে ছিলেন তিনি। জীবনানন্দ দাশের ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’ কবিতাটিতে সুর দিয়ে তিনি সুরকার হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠার ভিত শক্ত করেন এবং গানটি গেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। অজিত রায় সারা জীবন গণসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীতে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। শহীদুল ইসলামের রচনায় ‘স্বাধীন স্বাধীন দিকে দিকে জাগছে বাঙালিরা’ গানটিতেও সুর দিয়েছিলেন অজিত রায়। এ ছাড়া পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের সময়কার ‘বিচারপতি তোমার বিচার’, ‘বল বীর’ গানগুলো গেয়েও তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। ‘বল বীর’ গানটি সুর করেছিলেন শেখ লুৎফর রহমান; কিন্তু অজিত রায়ের গায়কিতে এ যেন এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল।
ষাটের দশকে প্রথম যখন রংপুর থেকে ঢাকায় আসেন, তখন তিনি আমার বেইলি রোডের বাড়িতে উঠেছিলেন। গানচর্চার জন্য জায়গা পাচ্ছিলেন না বলে আমাদের বাড়ির একটি ঘর তাঁকে সংগীতচর্চার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর তিনি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠন ক্রান্তি, উদীচী ও ছায়ানটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে তিনি পাক-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি ও আফ্রো-এশীয় সংহতি পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সর্বশেষ তিনি অভ্যুদয় নামে নিজে যে সংগঠন করলেন, সেটি রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন। এ প্রতিষ্ঠানটি শুধু ঢাকায় নয়, চট্টগ্রামেও এর শাখা রয়েছে। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা রবীন্দ্র ও গণসংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। তিনি চেষ্টা করেছিলেন তাঁর ছাত্রছাত্রীরা যেন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। তাঁর মেয়ে শ্রেয়া (শ্রেয়সী) রবীন্দ্রভারতী থেকে শিক্ষা গ্রহণের পর দেশে ফিরে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেছে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আমরা যাঁরা ঢাকায় আছি, একটি সংগঠন করেছি ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কমিটি’ নামে। তিনি ছিলেন এই কমিটির প্রাণপুরুষ। যত অনুষ্ঠান আমরা পরিকল্পনা করতাম, তার সবগুলোতেই তিনি নেতৃত্ব দিতেন, অংশগ্রহণ করতেন। শেখ হাসিনা যখন বিরোধী দলের নেত্রী ছিলেন, তখন তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের ডাকতেন, তাঁদের স্মৃতিচারণা শুনতেন, নিজেও স্মৃতিচারণা করতেন। অজিত রায়কে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতেন শেখ হাসিনা।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অজিত রায়ের ছিল অসাধারণ ভূমিকা। গান গেয়েছেন, সুর করেছেন, ছেলেমেয়েদের গলায় গান তুলে দিয়েছেন। সত্যিকার অর্থেই গণসংগীত গাওয়ার গলা ও স্টাইল আমরা অজিত রায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫। তিনি বলতেন, যে জায়গায় তিনি পৌঁছেছেন, তাতে সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে মায়ের শিক্ষা। মায়ের শিক্ষাই তাঁকে বড় হতে সাহায্য করেছিল। রংপুরে মা যখন গান গাইতেন, অজিত রায় তবলায় সহায়তা করতেন মাকে।
অজিত রায় মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অবদান রেখেছেন। অবদান রেখেছেন গণঐক্য গড়ে তোলার কাজেও। অজিত রায়ের মৃত্যুতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি পাতা ঝরে গেল। তাঁর মতো একজন দ্বিতীয় অজিত রায় আর জন্মাবে না।
কামাল লোহানী: সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক।

No comments

Powered by Blogger.