বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-প্রবাসীরা বিনিয়োগে আগ্রহী, কিন্তু... by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

জাপান প্রবাসীরা দেশে বিনিয়োগ করতে চান এ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন কালের কণ্ঠে বেরিয়েছে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২। জাপান প্রবাসী এক ব্যবসায়ীর একটি সাক্ষাৎকারও প্রকাশিত হয়েছে একইসঙ্গে। নিকট-অতীতে প্রবাসীদের সংগঠন 'ফোরাম ফর রেমিট্যান্স ইনভেস্টমেন্টে'-এর সদস্যরা ঢাকায় রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, দেশে যেন প্রবাসীদের বিনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়।
সার্বিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে এ কথা প্রশ্নাতীতভাবেই বলা যায়, তাঁদের এ মনোভাব অত্যন্ত প্রশংসাযোগ্য। জাপান প্রবাসীদের দেশে উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ করার ইচ্ছা নতুন করে প্রকাশ, এটি সুসংবাদ হলেও তাঁরা এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান কিছু প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতার কথাও তুলে ধরেছেন গুরুত্বের সঙ্গে। দেশে বিনিয়োগে তাঁদের ইচ্ছা প্রকাশ নিঃসন্দেহে দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধের পরিচয়ও বহন করে। সরকারও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বারবার গুরুত্বারোপ করছে। কিন্তু সরকারের এই গুরুত্বারোপ অনেকটা অরণ্যে রোদন বলা চলে। কারণ বিনিয়োগ করুন, বিনিয়োগ করুন_এই আহ্বান জানালেই তো শুধু চলবে না, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টির নিশ্চয়তাটুকু সর্বাগ্রে দরকার। দুঃখজনক হলেও সত্য, সে রকম পরিবেশ-পরিস্থিতি দেশে বিদ্যমান নয় কিংবা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিতে দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি অনুকূল নয়।
ফিরে যাই একটু পেছনে। 'জমি নেই, ফিরে যাচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগ' (কালের কণ্ঠ, ৩০ অক্টোবর ২০১০), 'মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিদেশি উদ্যোক্তারা' (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১২ নভেম্বর ২০১০)_এই শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো তখন সরকারের বিনিয়োগ আহ্বানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। ওই প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছিল, বিদেশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চাহিদামাফিক জমি এবং অবকাঠামোগত বাধার কারণে এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা না পাওয়ায় হাত গুটিয়ে চলে যাচ্ছে। বিনিয়োগ বোর্ড সূত্রের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনগুলোতে আরো বলা হয়েছিল, বিগত দুই মাসে অন্তত পাঁচ বিদেশি উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করতে এসেও আশ্বস্ত হতে পারেননি। সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতেও এসব বিষয় উল্লেখের পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে বিনিয়োগে আগ্রহী প্রবাসীরা দায়ী করেছেন। ২০১০ সালের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউ ইয়র্কের গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে মার্কিন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠককালে বাংলাদেশে কেন বিনিয়োগ করা উচিত_এ ব্যাপারে সবিস্তারে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাধা আছে অনেক। এ যাবৎ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি, বরং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ-আগ্রহ সংগতই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। ২০০৮-১০ সাল পর্যন্ত বিশ্বমন্দা পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক অর্থনীতিকে অনেকটা টালমাটাল করলেও এর বিরূপ প্রভাব থেকে বাংলাদেশ রক্ষাই পেয়েছিল। বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রথমত, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা; দ্বিতীয়ত, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট; তৃতীয়ত, ক্রমাবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও চতুর্থত, অবকাঠামোগত সমস্যা। বিনিয়োগ না আসা কিংবা হ্রাস পাওয়া অথবা কাঙ্ক্ষিত মাত্রা স্পর্শ না করার কারণগুলো অচিহ্নিত নয়। যেসব কারণে দেশি বিনিয়োগকারী কিংবা বিনিয়োগে আগ্রহীরা পিছপা হচ্ছেন বা থেমে আছেন, সেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসবেন কোন সাহস বা যুক্তিতে_এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় সংশ্লিষ্টদের।
গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই এবং আশানুরূপ না হলেও এ ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে বটে। এ ব্যাপারে সিংহভাগ সচেতন মানুষেরও কোনো দ্বিমত নেই। তবে এটুকু অগ্রগতি এ খাতের জন্য পথ মসৃণ করতে যথেষ্ট নয়। দেশে যেসব দেশি-বিদেশি শিল্প-কারখানা চালু আছে, সেগুলো নানা রকম প্রতিকূলতা ডিঙিয়েই চলছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে এবং এ অবস্থায় শঙ্কা থেকেই যায়, যদি পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটে তাহলে রুগ্ণ শিল্প-কারখানার তালিকা দীর্ঘ হবে। বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকঋণ পরিশোধে অপারগ হবেন। এর বিরূপ ধাক্কা বিপর্যস্ত অর্থনীতির জন্য আরো অসহনীয় হয়ে পড়বে। ঋণের সুদ গণনা তো আর থেমে থাকবে না। এই সুদ গণনা বিনিয়োগকারীদের জন্য বিষফোঁড়াসম। অন্যদিকে ঋণ পরিশোধ না হলে অর্থনীতির প্রবাহ চরম বাধাগ্রস্ত হবে_এটিই তো স্বাভাবিক। ঋণদাতা ব্যাংকগুলো কী ঋণের ব্যাপারে নমনীয়তা প্রদর্শন করতে পারবে? এর সহজ-সরল জবাব হলো, না। তাহলে দেশের শিল্পখাতের সুরক্ষা কিংবা বিকাশ কিভাবে সম্ভব? এ প্রশ্নই শেষ নয়, নেতিবাচক দিক আরো আছে। বিপুল কর্মহীনের এই দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতি আরো সংকট সৃষ্টি করবে। প্রবাসীরা দেশে অর্থ প্রেরণও কমিয়ে দিতে পারেন। এর ফলে রেমিট্যান্স-প্রবাহ কমবে, কর্মসংস্থানও সংকুচিত হবে। সমন্বয়হীনতা, বিপরীতমুখী নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অর্থাৎ লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি, রাজনৈতিক সংকট আর দুর্নীতির কারণে অতীতেও অনেক দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ দোরগোড়ায় এসেও ফিরে গেছে। কাজেই শুধু 'বিনিয়োগ বিনিয়োগ' বলে আহ্বান জানালেই চলবে না, সর্বাগ্রে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। বাংলাদেশ অবশ্যই বিনিয়োগের জন্য চমৎকার দেশ। এখানে শ্রম সস্তা, আবহাওয়া যথেষ্ট অনুকূল। পরিবহন খরচ তুলনামূলক কম। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ উৎপাদন-সহায়ক বিষয়গুলো বড় বেশি প্রশ্নবোধক। সবচেয়ে বড় কথা হলো_ আমাদের মানসিকতার বদল খুব জরুরি। একটা কথা তো সত্যি, আমরা না বদলালেও বিশ্বব্যাপী দিন দ্রুত বদলাচ্ছে। সর্বত্র চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা। প্রতিটি দেশেই কম-বেশি রাজনৈতিক মতবিরোধ আছে, নানা রকম সমস্যাও আছে। কিন্তু আমাদের মতো জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা কোথায় এত প্রকট?
প্রবাসীরা উৎপাদনমুখী খাতে দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হলেও এ ব্যাপারে সরকারের তরফে যা কিছু পরিলক্ষিত হয়, তা শুধুই উচ্চারণসর্বস্ব_এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রবাসীরা বিনিয়োগ করতে না পেরে তাঁদের অর্থ গাড়ি ক্রয়, বাড়ি বানানো, জমি-ফ্ল্যাট ক্রয়_এমন অনুৎপাদনশীল খাতে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ব্যয় করছেন। এর বাইরেও প্রবাসীদের পাঠানো বিপুল অর্থ অলসভাবে ব্যাংকে পড়ে থাকে; কিন্তু দেশে তাঁদের পাঠানো অর্থ বিনিয়োগমুখী করা গেলে দেশের অর্থনীতির চেহারা বদলে যেত, সমাজচিত্র অনেক উজ্জ্বল হতো। কাজের ক্ষেত্র সংগতই বিস্তৃত হতো। এর ফলে বেকারত্ব, সামাজিক অস্থিরতা, অপরাধপ্রবণতাও হ্রাস পেত। এই বাস্তবতা সরকার ও বিরোধী পক্ষের সবাইকেই সমানভাবে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। দেশে প্রবাসীদের বিনিয়োগসংক্রান্ত ব্যাপারে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোরও করণীয় আছে অনেক কিছু। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বেশির ভাগ মিশনে কর্মরতদের বিরুদ্ধে দায়-দায়িত্ব পালনে যেখানে প্রবাসীদের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ, সেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট তারা কতটা কি করছেন তাও সহজেই অনুমেয়। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর দায়দায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন আছে। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ সিলেটসহ দেশের প্রায় সব কয়টি বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তা আশার আলো দেখছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তথ্য অনুযায়ী সিলেট অঞ্চলের প্রবাসীরা চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরেই বেশি রেমিট্যান্স পাঠান। সিলেটে লন্ডনপ্রবাসীর সংখ্যা অনেক বেশি; কিন্তু তাঁদের প্রেরিত অর্থের বড় অংশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ ও ভোগবিলাসে যায়, যা দ্রব্যমূল্যে প্রভাব বিস্তার করা ছাড়া অন্য কোনো কাজে আসে না। যেমন, সিলেটে জীবনযাত্রার ব্যয় এত উঁচু, তা দেশের অন্যত্র বাস করে ধারণা করাও কঠিন। তবে সম্প্রতি সিলেটের প্রবাসীদের বিনিয়োগ-আকাঙ্ক্ষা ব্যাপকভাবে তাড়া করছে; কিন্তু তাঁরা এই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ-পরিস্থিতি পাচ্ছেন না। সরকার শুধু 'বিনিয়োগ বিনিয়োগ' বলে চিৎকার না করে আগে বিদ্যমান প্রতিকূলতাগুলো দূর করুক, দেশের সব কয়টি রাজনৈতিক দল হীনস্বার্থবাদী রাজনীতি পরিহার করে জনকল্যাণের রাজনীতিতে ব্রতী হোক, বিনিয়োগের রাস্তা এমনিতেই প্রশস্ত হবে। সরকারের উদ্যোগের কারণেই দেশে এখন বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ অনেক বেড়েছে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার স্ফীত হচ্ছে। বিনিয়োগের ব্যাপারেও যদি সরকার সে রকম উদ্যোগ নেয় কিংবা ব্যবস্থাটা ভালো করে এবং সর্বাগ্রে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিরসনে রাজনীতিকরা যদি ঐকমত্যের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে নিশ্চয়ই বিনিয়োগে আগ্রহী প্রবাসীরা পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে তৎপর হবেন। বিদেশি বিনিয়োগকরীরাও আকৃষ্ট হবেন। আভাস তো বারবারই মিলছে। চাই শুধু সরকারের নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক নেতাদের বাস্তবতা অনুধাবন করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের সক্ষমতা।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.