তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবলুপ্তি ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি by ওয়াহিদ নবী

খালেদা জিয়া বিদেশে থেকেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, দেশে ফিরেই তিনি মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে জোরদার আন্দোলনের ঘোষণা দেবেন। দলের নেতারা, যাঁরা দেশে ছিলেন তাঁরাও এসব কথা বলছিলেন এবং প্রস্তুত হচ্ছিলেন আন্দোলনের কর্মসূচি পালনের জন্য। তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন নেত্রীর ফেরার জন্য।


সে জন্যই দিন-তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। তাঁর দেশে ফেরার পর ছিল জিয়াউর রহমানের মৃত্যুদিবস। সেই দিনটির কর্মসূচি পালন করছিলেন দলের নেতা-কর্মীরা। এসব নিয়ে তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুদিবস পালনের পর পরই মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য আন্দোলনের কার্যসূচি ঘোষণা করবেন; কিন্তু হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অবলুপ্ত করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা বোমশেলের মতো। হঠাৎ করে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি হাওয়ায় উড়ে গেল। অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল মধ্যবর্তী নির্বাচনের সব বিতর্ক। তার জায়গা দখল করে বসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্বন্ধীয় বিতর্ক। বিএনপি নেতারা নিশ্চয়ই মধ্যবর্তী নির্বাচনের আন্দোলনের অংশ হিসেবে এ বিষয়ে যে হ্যান্ডবিল ও পোস্টার ছাপিয়েছিলেন, সেগুলো প্রায় অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। ইংরেজিতে যাকে 'রং ফুটেড' করা বলে, তাই বিএনপিকে করলেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু বিএনপিকে নয়, আরো অনেককে 'রং ফুটেড' করলেন প্রধানমন্ত্রী। পর্যবেক্ষক বা লেখকরা_যাঁরা বিএনপি প্রস্তাবিত মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক আরো চলবে আশা করে এ বিষয়ে তাঁদের লেখা সম্পাদকদের কাছে পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা দেখলেন তাঁদের লেখা এখন প্রায় অপ্রাসঙ্গিক। হঠাৎ করে সবাইকে তাঁদের চিন্তাধারা পরিবর্তন করতে হলো। হতচকিত এবং ক্রুদ্ধ বিএনপি অবশ্য কিছুটা সামলে নিয়েছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে যে আন্দোলনের প্রস্তুতি তারা নিয়েছিল, তার কিছুটা তারা কাজে লাগাতে পারছে।
বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের অনেকের মতে, যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথা অসাংবিধানিক হয় তবে আরো দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয় কী করে? এ ক্ষেত্রে সরকার সমর্থকরা বলতে পারেন, বেআইনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন যদি সাংঘর্ষিক হয় তবে এই বেআইনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না করলেই তো ঝামেলা চুকে গেল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথা বেআইনি থেকে গেল। নির্বাচন হলো না তাদের অধীনে। সংঘর্ষ থেমে গেল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বেআইনি কাজ করার দায়-দায়িত্ব তিনি নেবেন না। নিক কোহেন তাঁর 'হোয়াটস লেফট' বইতে লিখেছেন, রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা হচ্ছেন ফুটবল ক্লাবের সমর্থকদের মতো। তাঁরা নিজের দলের খেলোয়াড়দের কোনো দোষ দেখেন না। আর অন্য দলের খেলোয়াড়দের কোনো গুণ তাঁদের চোখে পড়ে না। এই কথা গুণগত দিক দিয়ে সব দেশেই প্রযোজ্য, কিন্তু পরিমাণগত দিক দিয়ে দেশে দেশে কিছু পার্থক্য আছে। আমাদের প্রধান দুই দলের ভেতর সম্পর্ক আরেকটু ভালো হলে দেশ ও জাতির জন্য ভালো হতো। আমাদের দেশের সবাই প্রশ্নবিদ্ধ। রাজনীতিবিদ, পুলিশ, ব্যবসায়ী, কাস্টমস_কারা আছেন আমাদের দেশে, যাঁরা প্রশ্নবিদ্ধ নন! এখন আমাদের বিচার বিভাগও প্রশ্নবিদ্ধ। দুই দলই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মনে করে, বিচার বিভাগ দলীয়করণে দূষিত। কাজেই বিচারের রায় যদি এক পক্ষের পছন্দ হয়, তবে অন্য পক্ষের অপছন্দ এবং এই পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটা তীব্র আকারের। এ সমস্যা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে এ জন্য যে সংবিধান অনুযায়ী শেষ প্রধান বিচারপতি যিনি অবসর গ্রহণ করবেন, তিনিই হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
বিএনপি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, বিচারপতি খায়রুল হককে তারা প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে গ্রহণ করবে না। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থক। তাঁর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আছে কি না জানি না। তিনি কোনো দিন ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন_এ কথা কেউ বলেননি। অভিযোগকারীরা বলেন, তিনি যে রায়গুলো দিয়েছেন সেগুলো আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে এবং অন্যায়ভাবে এ রায়গুলো তিনি দিয়েছেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক পটভূমির আলোচনা আমরা একটু আগেই করেছি। এক পক্ষের কাছে আদালতের রায় অনুকূল হলে আরেক দলের কাছে তা প্রতিকূল হবেই। বিএনপি সমর্থকদের কাছে জিয়াউর রহমান অত্যন্ত প্রিয়। মনস্তত্ত্ববিদ্যায় 'রিপারটরি গ্রিড' বলে একটা কথা আছে, যার অর্থ হচ্ছে_মানুষ যাকে ভালো মনে করে তার কোনো দোষ তার চোখে পড়ে না। ফুটবল দলের সমর্থকদের কথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। জিয়াউর রহমানের অনেক গুণ ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি ছিলেন সেনাকর্তা। সেনাকর্তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কোনো দেশেই গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো দেশেই সামরিক আইনের ঘোষণা আইনের চোখে গ্রহণযোগ্য নয়। খালেদা জিয়ার বাড়ি বলে যে বাড়িটি বর্ণনা করা হয়, সেটি আসলে সরকারি বাড়ি। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এটাও বলা যায়, আদালতে খালেদা জিয়ার কেঁৗসুলিদের আচরণ তাঁকে সাহায্য করেনি। ১৯৯৬ সালে তখনকার সময়ের প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথা চালু হয়েছিল। ১৫ বছর পেরিয়ে গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সকার কোনো সময়ই বিতর্কমুক্ত ছিল না। প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ ও বিচারপতিদের বয়সসীমা বাড়ানো অনেকে পছন্দ করেননি। রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টা বানানো দৃষ্টিকটু বলে মনে হয়েছিল অনেকের কাছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতে গেলে বিএনপি সেটাকে পাতানো খেলা বলে বর্ণনা করেছে। এবার সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টাকে গ্রহণযোগ্য নয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এই যদি অবস্থা হয়, তবে তত্ত্বাবধায়ক ছাড়াই নির্বাচন করে দেখা যাক না কেন। সরকার যদি দেশ রক্ষার দায়িত্বসহ রাষ্ট্রের সব দায়িত্ব নিতে পারে, তবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নিতে পারবে না কেন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে প্রধান দুটি দলসহ সবাই ভুগেছে। 'মাইনাস টু' তত্ত্বের প্রবক্তা যতই বরেণ্য ব্যক্তি হন না কেন, তিনি গণতন্ত্রের বন্ধু নন। তিনি আইনের ঊধর্ে্ব নন। আজ এক দল তাঁর বিরুদ্ধে হয়েছে বলেই আর এক দল তাঁর বন্ধু হবে এ কেমন কথা। পৃথিবীর কোনো দেশেই কোনোকালে এ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল এমন কথা আমাদের জানা নেই। ১৫ বছর ধরে আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আছে। এটা কী জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জার বিষয় নয়? আর কত? গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজগুলো একবার মনে করুন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। আর তাঁরা কী করেছে? সূর্যের নিচে এমন কিছু কী ছিল, যা তাঁরা করার চেষ্টা করেনি?
নিজেদের মেয়াদ তারা নিজেরাই বাড়িয়ে দিয়েছিল। 'রয়াল' পার্টিসহ অনেকের সাহায্য নিয়ে তারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করেছে। জনগণের তীব্র বিরোধিতার কারণে তা তারা করতে পারেনি। এসব কথা মনে রেখে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আবেদন করব গণতান্ত্রিক দলের মতো ব্যবহার করতে। আবেদন করব গণতন্ত্রীর মতো করে চিন্তা করতে। মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রের কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে। মাইকেল সার্ভেটাস তাঁর 'ভায়োলেন্ট ডেমোক্রেসি' বইতে লিখেছেন_গণতন্ত্রের জন্ম হয়েছে পুঁজিবাদ থেকে। 'দি অঙ্ফোর্ড হিস্ট্রি অব ব্রিটেন' বইতে উল্লেখ আছে, ইংরেজ কর্তৃক ভারত জয়ের পর ভারত থেকে অনেক টাকা নিয়ে ফিরে আসা ব্যবসায়ীরা পয়সার জোরে নির্বাচনে জিততেন। তাঁদের দেখলেই লোকে বলত, 'নওয়াবস আর কামিং'। আগে সংসদের ভেতরে সংসদ সদস্যরা তলোয়ার নিয়ে মারামারি করেছেন, যা দেখে ত্যাক্ত-বিরক্ত ওলিভার ক্রমওয়েল অস্ত্র হাতে তাঁদের নিরস্ত্র করেছেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা এগিয়ে গেছেন। আমাদের গণতন্ত্রীরা নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ অন্য সব দায়িত্ব পালনের সাহস ও নিষ্ঠা পালন করুন_এটাই আমাদের প্রার্থনা। নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো একটা দায়িত্ব যদি অগণতান্ত্রিক শক্তির হাতে ছেড়ে দিয়ে রাখতে হয়, তবে আমাদের গণতন্ত্র কোনো দিন অগ্রসর হবে না।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.