সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানচেষ্টা তদন্ত শেষ পর্যায়ে, মার্চ থেকে বিচার শুরু-সময় ১০ জানুয়ারি লক্ষ্য গণভবন by কামরুল হাসান

১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। এ বছরের ওই দিনকে অভ্যুত্থানের জন্য বেছে নিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য। আর তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল গণভবন। সশস্ত্র বাহিনী এই বিপথগামী সদস্যদের চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়।


তথাকথিত এই অভ্যুত্থানের সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। এর সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় ‘বোনের বিয়ে’। ওই দিন নির্ধারিত সময়ে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা ঢাকা সেনানিবাসের কোত (অস্ত্রাগার) থেকে অস্ত্র নেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন।
অভ্যুত্থানচেষ্টায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার হওয়া সিগন্যালসের মেজর মাহমুদ শাহেদ এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন মো. তামজিদ আলম বেসামরিক আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন। গত ২৯ জানুয়ারি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের দুটি আদালতে এ দুই কর্মকর্তা জবানবন্দি দেন।
এ নিয়ে সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানচেষ্টার ঘটনায় এখন পর্যন্ত চার সেনা কর্মকর্তা বেসামরিক আদালতে জবানবন্দি দিলেন। এর আগে লে. কর্নেল (অব.) এহসান ইউসুফ ও মেজর (অব.) জাকির হোসেন জবানবন্দি দেন।
সেনা সূত্র জানায়, অভ্যুত্থানচেষ্টার ঘটনায় গঠন করা ছয়টি তদন্ত আদালতের কাজ চলতি মাসেই শেষ হতে পারে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার শুরু হবে মার্চ থেকে। এ ঘটনায় কমপক্ষে ২৫ জন সেনা কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন—এখন পর্যন্ত এমন তথ্য-প্রমাণ মিলেছে বলে জানা গেছে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাও আছেন। সেনা কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় মেজর জিয়া সম্পর্কে ‘বড় ভাই’ সাংকেতিক নাম ব্যবহার করতেন।
অভ্যুত্থানচেষ্টার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা কেন ১০ জানুয়ারি দিনটি বেছে নিয়েছিলেন—জানতে চাইলে একজন পদস্থ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ওই সময় সেনাবাহিনীর শীতকালীন প্রশিক্ষণ চলছিল। বেশির ভাগ সেনাসদস্য ও যানবাহন সেনানিবাসের বাইরে ছিল। তা ছাড়া ১০ জানুয়ারি হলো বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ওই দিন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দিনের কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এর আগের দিন (৯ জানুয়ারি) বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রামের উদ্দেশে রোডমার্চ করেন।
অভ্যুত্থানচেষ্টা নিয়ে গত ১৯ জানুয়ারি সেনাসদরের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত ২৩ ডিসেম্বর ছুটিতে থাকার সময় মেজর জিয়াউল পালিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নাশকতামূলক (সাবভারসিভ) কার্যক্রম চালানোর পাঁয়তারা করতে থাকেন।
আদালত সূত্র জানায়, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মেজর মাহমুদ শাহেদ ও ক্যাপ্টেন মো. তামজিদ আলম বলেছেন, ১০ জানুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত মেজর জিয়া সক্রিয় ছিলেন। মোবাইল ফোন ও ই-মেইলের মাধ্যমে তিনি প্রতি মুহূর্তে কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের অভ্যুত্থানের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। এসব কাজের জন্য জিয়া একাধিক ফোন নম্বর, ই-মেইল ঠিকানা ও সাংকেতিক নাম ব্যবহার করেন। শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেন মেজর জিয়া।
মেজর মাহমুদ জবানবন্দিতে যা বলেন: মেজর মাহমুদ বলেছেন, ধর্মীয় আলাপ-আলোচনার সূত্র ধরে মেজর জিয়ার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। মেজর জিয়া তাঁর বাসায় কয়েকজন সমমনা কর্মকর্তাকে ডেকে বলেন, সেনাবাহিনী থেকে দাড়িওয়ালা লোকদের ধরে নেওয়া হচ্ছে; যাঁদের স্ত্রীরা পর্দা করেন, তাঁদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এ জন্য সবাইকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন জিয়া।
মাহমুদ তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ২৫ ডিসেম্বর তিনি জানতে পারেন, মেজর জিয়া আত্মগোপন করেছেন। এর এক দিন পর তিনি জিয়ার একটি ই-মেইল পান। কিন্তু ভয়ে সেটা মুছে ফেলেন। ১০ জানুয়ারি বিকেলে এক কর্মকর্তা অজ্ঞাত নম্বর থেকে ফোন করে তাঁকে বলেন, ‘তোমার মেইলে বিয়ের দাওয়াত পাঠানো হয়েছে। সময়মতো এসো।’ রাত সাড়ে নয়টায় জিয়া নিজেই তাঁকে ফোন করে বলেন, ‘কয়েকটি ব্যাটালিয়ন অভিযান শুরু (মুভ) করেছে। তুমিও শুরু করো।’
এরপর মেজর মাহমুদ আরও কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন। রাত ১০টার দিকে তিনি নিজের ব্যাটালিয়নে কর্তব্যরত কর্মকর্তাকে ফোন করে জানতে চান অস্ত্রাগারের (কোয়ার্টার গার্ড) চাবি কার কাছে এবং বাইরে কোনো অস্ত্র আছে কি না। পরে জিয়াকে ফোন করে বলেন, বাইরে কোনো অস্ত্র নেই। এখন অস্ত্র নেওয়া সম্ভব নয়। এতে জিয়া ক্ষিপ্ত হন। মাহমুদ বলেন, রাত ১১টার দিকে তিনি চাবি আনার জন্য আবার কোয়ার্টার গার্ডে যান। কিন্তু সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তা তাঁকে বলেন, চাবি অন্য একজন কর্মকর্তার কাছে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে ফিরে আসার জন্য গাড়িতে ওঠার সময় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাঁকে আটক করেন।
ক্যাপ্টেন তামজিদ যা বলেছেন: বেসামরিক আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ক্যাপ্টেন তামজিদ বলেছেন, শীতকালীন মহড়ায় তিনি সৈয়দপুরে ছিলেন। ৮ জানুয়ারি তিনি বিদেশে প্রশিক্ষণে যাওয়ার জন্য ঢাকায় আসেন। মেজর জিয়ার সঙ্গে তাঁর আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। ৮ জানুয়ারি মেজর জিয়া তাঁকে ই-মেইলে অভ্যুত্থানের একটি পরিকল্পনা পাঠান। এতে কারণ সম্পর্কে বলা হয়, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের হোতাদের বের করা, সেনাবাহিনীতে একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার তত্পরতা ও কিছু কর্মকর্তার দাড়ি ও হিজাববিদ্বেষের কথা। নির্দেশনায় বলা হয়, ‘যতটা সম্ভব অস্ত্র, গাড়ি ও লোক নিয়ে ঢাকায় এসো।’ সময় নির্ধারণ করা হয় ১০ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাতটা ৩০ মিনিট। বলা হয়, লক্ষ্য গণভবন। আরও বলা হয়, একজন জিওসিকে (এরিয়া কমান্ডার) আটক করা হয়েছে, তাঁকে মুক্ত করে সেনাপ্রধান করতে হবে। তামজিদ বলেন, জিয়া মনে করেছিলেন তিনি সৈয়দপুরে আছেন। তাই ই-মেইল করে জানান, তিনি ঢাকায় এসেছেন। এরপর জিয়া তাঁকে বলেন, তাঁর ব্যাপারে পরে সব জানানো হবে।
ক্যাপ্টেন তামজিদ বলেন, ৯ জানুয়ারি সকালের দিকে আরেকটি মেইলে কাদের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে তা জানান মেজর জিয়া। ওই দিন দুপুরের দিকে আরেকটি মেইল পাঠান জিয়া। এতে দেখা যায়, কী করতে হবে তার নির্দেশনা রয়েছে। আর রয়েছে একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার দালাল হিসেবে কথিত ৫০০ লোকের নামের তালিকা। এতে রাজনৈতিক নেতা ও সেনা কর্মকর্তারদের নাম আছে। জিয়া তাঁর বার্তায় বলেন, মধ্যম সারির কর্মকর্তারা সেনাবাহিনীতে পরিবর্তন আনবেন।
তামজিদ আরও বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের নামের তালিকা দেখে তিনি ভড়কে যান। জিয়াকে মেইল করে জানান, সেনানিবাসের প্রতিটি ফটকে এক সেকশন করে সৈন্য পাহারা দিচ্ছে। গোয়েন্দা কার্যালয়ে প্রতিটি সৈনিকের হাতে অস্ত্র রয়েছে। ১০ জানুয়ারি বিকেলে জিয়া তাঁকে ফোনে বলেন, তিনি ঢাকায় আছেন। এ সময় তিনি আরও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে গোপন ফোন নম্বর ও ই-মেইল ব্যবহার করে যোগাযোগ করেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে জিয়া তাঁকে ফোন করে ইঞ্জিনিয়ার্স ব্রিগেডের সঙ্গে থাকতে বলেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে জিয়া আবার তাঁকে ফোন করে বলেন, বগুড়া, ঘাটাইলসহ বিভিন্ন স্থান থেকে সেনাসদস্যরা ঢাকায় আসতে শুরু করেছেন। জিয়া বলেন, তিনি নিজে ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ার্স ব্রিগেডের দিকে যাচ্ছেন। এভাবে রাত ১২টা পর্যন্ত তাঁরা নানা তথ্য আদান-প্রদান করেন। রাত ১২টায় জিয়া তাঁকে হতাশার সুরে বলেন, ‘কিছুই বুঝতে পারছি না, অনেকেই বের হওয়ার কথা ছিল, বের হয়নি। কারও কোনো সাড়াশব্দ নেই। সব চুপচাপ।’ এভাবেই শেষ হয় ১০ জানুয়ারি।
ক্যাপ্টেন তামজিদ বলেন, অভ্যুত্থানচেষ্টার ব্যাপারে কোনো খবর আছে কি না—সে ব্যাপারে জানতে ১১ জানুয়ারি তিনি মেজর জিয়া ও অন্যদের ই-মেইল পাঠান। পরদিন ১২ জানুয়ারি নিজের কাজের জন্য সেনা সদর দপ্তরে গেলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.