সরল গরল-অমীমাংসিতই থাকবে সমুদ্রসীমা? by মিজানুর রহমান খান

প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে দুই দেশের সম্পর্কের সব বিষয় আলোচনায় আসবে। সম্ভবত একটি বাদে। আর সেটি হলো, সমুদ্র সীমানা। রোববার সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলাম, আলোচনার কি কোনো সুযোগ নেই? তিনি বললেন, আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে বলেই বাংলাদেশ এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সালিস আদালতে গেছে।


অবশ্য গোড়াতেই বলা হয়েছিল, এই উদ্যোগ সত্ত্বেও আলোচনা চালিয়ে যেতে বাংলাদেশের আগ্রহ থাকবে। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, আদালতে দাবিনামা দাখিলের পর এর সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে।
ভারতের সঙ্গে দিল্লিতে সবশেষ আলোচনা হয় ২০১০ সালের মার্চে। মিয়ানমারের সঙ্গে সবশেষ বৈঠক হয় গত বছরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে। ২০০৯ সালের অক্টোবরে দুই দেশের দূতকে নাটকীয়ভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তখনই দুজনের কাছে দুটি চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়। সমুদ্রসীমা ইস্যুতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখান থেকেই শুরু করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আমলে ছয় দফা বৈঠক হয়েছিল, তা ফলপ্রসূ হয়নি। বাংলাদেশ একতরফা তার সমুদ্রসীমা ঘোষণা করে ১৯৭৪ সালে আইন করেছিল। ভারত ও মিয়ানমার যথারীতি আপত্তি করেছিল। সেই থেকে সেই আইন অকার্যকর। সাড়ে ছয় কিলোমিটার অমীমাংসিত সীমানা চিহ্নিত করতে দুই দশকের বেশি সময় কেটে গেছে। আর সমুদ্রে কয়েক হাজার কিলোমিটারের বিষয়। ভারত ও মিয়ানমার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করার কাজ মিটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ তাদের কাছে ব্যতিক্রম। কারণ, বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল কনকেভ প্রকৃতির বা ধনুকের ন্যায় ভেতরের দিকে বক্রতাযুক্ত। ভারতের উপকূল কনভেক্স বা বৃত্তের মতো ক্রমোন্নত তলবিশিষ্ট। বাংলাদেশের উপকূলীয় রেখা পৃথিবীতে কম হলেও বিরল নয়। এ ধরনের উপকূলীয় রেখা (যেমন নর্থ সি) আছে বলেই ন্যায়পরতা পদ্ধতিতে সমুদ্রের সীমানা চিহ্নিতকরণের উদ্ভব ঘটে। সাধারণভাবে সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করা হয় সমদূরত্ব পদ্ধতিতে। যেমন, ভারত এই পদ্ধতিতে তার অপরাপর সমুদ্র সীমান্ত প্রতিবেশী—শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও মালদ্বীপের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে নিয়েছে। চুক্তি করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধ থাকলেও তা এই পদ্ধতিগত নয়।
আমরা স্মরণ করতে পারি, অন্ধ ভারত-বিরোধিতার প্রতিভূ বেগম খালেদা জিয়া এর আগে জাতিসংঘে গিয়ে পানির হিস্যা প্রশ্নে ভারতের বিরুদ্ধে মৌখিক বক্তব্য রেখেছিলেন মাত্র। পানি ও সমুদ্রসীমা প্রশ্নে সালিস আদালতে যাওয়ার সুযোগ তিনি নেননি।
সম্প্রতি এক ভারতীয় কর্মকর্তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, দুই দেশের মধ্যে বর্তমানে রাজনৈতিক বোঝাপড়া যথেষ্ট উষ্ণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তিটা, বিশেষ করে, বিরোধী দল এমন করে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে যে, তিনি ভারতকে পারলে একটু বেশিই সুবিধা দিয়ে দিচ্ছেন। আর ঠিক তখন শেখ হাসিনাই ভারত প্রশ্নে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। এটা কি রাজনৈতিক শুভেচ্ছার বাতাবরণে নিরসনযোগ্য নয়? জবাবে ওই কর্মকর্তা তাঁর অভিব্যক্তি দিয়ে প্রশ্নের জোরটা মেনে নিলেন। কিন্তু যুক্তি দিলেন ভারত যদি এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুযায়ী সমদূরত্ব পদ্ধতি পরিহার করে ন্যায়পরতা পদ্ধতি গ্রহণ করে, তাহলে ভারতকে জটিলতায় পড়তে হবে। অন্য প্রতিবেশীরা একই ধরনের সুবিধা চাইবে। তাঁর এই যুক্তি আমাদের ধাঁধায় ফেলেছিল।
রোববার এই যুক্তিটি বাংলাদেশি কর্মকর্তার কাছে তুলে ধরলাম। তিনি বললেন, ভারত যাতে সমদূরত্ব নীতি এড়িয়ে ন্যায়পরতা পদ্ধতি গ্রহণ করে, সে জন্য বর্তমান সরকার এক বছর ধরে আলোচনা করেছে। তারা মূলত ওই যুক্তিটিই তাদের অপারগতার কারণ বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু তাদের যুক্তি দুর্বল, অগ্রহণীয়। কারণ, আমাদের মতো সমুদ্র উপকূল ভারতের অন্যান্য প্রতিবেশীর নেই। তা ছাড়া তাদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই সম্পাদিত চুক্তিগুলো বহু বছর ধরে কার্যকর। এখন তার প্রতিবেশীরা বাংলাদেশের দিকে আঙুল তুলে তা পরিবর্তনের দাবি করতে পারে না।
বর্তমানে সমুদ্রসীমা ইস্যুটি কী পর্যায়ে আছে, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করে গতকাল যা জেনেছি, তা এ রকম: সমুদ্রসীমা বিরোধ-মীমাংসার জন্য জাতিসংঘ-স্বীকৃত দুটি ফোরাম রয়েছে। একটি হামবুর্গভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর ল অব দ্য সি। অন্যটি হেগভিত্তিক পারমানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশন। হামবুর্গের আদালতে ২১ জন বিচারক সংশ্লিষ্ট পক্ষদের বক্তব্য শুনে রায় দেন। আর হেগের সালিস আদালতের সালিসকারক হলেন পাঁচজন। দুটি ফোরামেরই প্রদত্ত রায় সংশ্লিষ্ট পক্ষদের জন্য চূড়ান্ত ও বাধ্যকর। কারও রায়ের বিরুদ্ধেই আপিল চলবে না। বাংলাদেশ প্রথমে গেছে সালিস আদালতে। কারণ, এ আদালতে যেতে বিবাদীর সম্মতি লাগে না। কিন্তু হামবুর্গের আদালতে যেতে উভয় পক্ষের সম্মতি লাগে। হামবুর্গের আদালতে মামলা চালাতে কোনো পক্ষকে খরচ জোগাতে হয় না। জাতিসংঘের তহবিল থেকেই তা মেটানো হয়। মিয়ানমারই প্রস্তাব দিয়েছিল হামবুর্গে যেতে। বাংলাদেশ তাতে সম্মত হয়, এমনকি ভারতকেও হামবুর্গের আদালতে যেতে প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ভারত তাতে রাজি হয়নি। দুই ফোরামের মধ্যে আরেকটি পার্থক্য হলো, হেগের সালিস আদালত থেকে রায় পাওয়া তুলনামূলক সময়সাপেক্ষ। কিন্তু হামবুর্গের আদালত থেকে রায় মেলে দ্রুত। মিয়ানমারের বিষয়ে বাংলাদেশ দাবিনামা দিয়েছিল গত বছরের ১ জুলাই। মিয়ানমার জবাব দিয়েছে গত বছরের ১ ডিসেম্বর। কোনো দীর্ঘসূত্রতার ব্যাপার নেই। ইতিমধ্যে কাগুজে চিঠি চালাচালি শেষ। ৮ সেপ্টেম্বর হামবুর্গের আদালতে মৌখিক শুনানি শুরু হবে। এতে যোগ দিতে রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম আজ সোমবার হামবুর্গের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি সম্ভবত ঢাকা ত্যাগ করবেন ৭ সেপ্টেম্বর। আদালতের ওয়েবসাইট থেকে দেখা যাচ্ছে, ২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মৌখিক শুনানি শেষ হবে। চূড়ান্ত রায় আশা করা হচ্ছে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে।
এখানে স্মরণযোগ্য যে চট্টগ্রামে গত বছরের জানুয়ারিতে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের কাছে একটা আশাবাদ ব্যক্ত করেছিল। তারা বলেছিল, মিয়ানমারের সঙ্গে বরফ গলছে। আলোচনায় অগ্রগতি ঘটেছে। সেই অগ্রগতিটা কী ছিল, তা প্রকাশ করা হয়নি। তবে রোববার জানলাম, মিয়ানমার বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ন্যায়পরতা পদ্ধতি মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিল। কিন্তু পরে এর অগ্রগতি ঘটেনি। অনেকের ধারণা, ভারত মিয়ানমারকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে বাংলাদেশ যখন আদালতেই গেছে, তখন সবকিছু সেখানেই সম্পন্ন হোক। এর সত্যতা আমরা যাচাই করতে পারিনি। তবে একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার শুনলাম। সেটা হলো, মাইকেল উডস এবং অ্যালেন প্যালেটের মতো ভারতের নিযুক্ত কৌঁসুলিরাই মিয়ানমারের পক্ষে হামবুর্গের আদালতে শুনানিতে অংশ নেবেন। গত ৩১ মে ভারতের বিষয়ে বাংলাদেশ তার দাবিনামা পেশ করেছে। ভারত এর লিখিত জবাব পেশ করবে ৩১ মে ২০১২। এর পরই ভারতের বিষয়ে শুনানি হবে হেগের সালিস আদালতে। সুতরাং আমরা ভারতের আগেই মিয়ানমার প্রশ্নে প্রথম রায় পাব। আর সেটা যদি বাংলাদেশের পক্ষে যায়, তাহলে হেগের সালিস আদালতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় তার একটা বোধযোগ্য মূল্য মিলতেই পারে।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ যদি হেরে যায় তাহলে কী হবে। বাংলাদেশের তখন রায় মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প খোলা থাকবে না। তাহলে বাংলাদেশ কি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার টেবিল ছেড়ে আদালতে গিয়ে ভুল করেছে? কারণ, রায়ে হেরে গেলে বাংলাদেশের কিছুই বলার থাকবে না। ভারতকে দোষারোপ করা যাবে না। এই প্রশ্নের জবাবে ওই বাংলাদেশি কর্মকর্তা উত্তর দিলেন এ রকম: ‘এটা ঠিক, প্রথাগত জয়-পরাজয়ের বিষয় নয়। জাতিসংঘ সমুদ্র আইন আনক্লজের ব্যাখ্যার আলোকে সিদ্ধান্ত আসবে।’ এ কথায় হেঁয়ালি আছে। আছে কূটনীতির মারপ্যাঁচ। আমরা তাই তাঁর কাছে সোজাসাপ্টা একটা ধারণা পেতে চাইলাম। বললাম, ঠিক করে বলুন তো রাজনৈতিক সদিচ্ছার বাতাবরণে আমরা যখন সাড়ে ছয় কিলোমিটার স্থায়ী সীমান্তের মীমাংসা পেতে যাচ্ছি, তখন হারলে ঠিক কত শত কিংবা কত হাজার মাইলের সমুদ্রসীমা চিরকালের জন্য আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে? কর্মকর্তাটি মাইলের হিসাবে গেলেন না। বললেন, বিগত বিএনপি সরকার গ্যাস ও তেল অনুসন্ধানে বঙ্গোপসাগরে ব্লক চিহ্নিতকরণের কাজ শুরু করে। তবে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেই ব্লক আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। ভারত ও মিয়ানমার এই বিষয়ে আপত্তি তুলেছে।
মনমোহনের সফরকে সামনে রেখে ২ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে প্রকাশিত চার সদস্যের ইনস্টিটিউট অব স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ‘এখানে উভয় দেশের “হাই স্টেকস” রয়েছে। তাই ট্রাইব্যুনালের রায়ের জন্য আমাদের অপেক্ষা করা উচিত।’ তবে বাংলাদেশের স্টেক ভারতের চেয়ে বহুগুণ বেশি। জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম হাবিবুর রহমান গতকাল বললেন, ভারতের প্রস্তাবমতে বাংলাদেশ কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা হারাবে।
এ তো গেল অঙ্কের হিসাব। বাংলাদেশের সালিস আদালতে যাওয়া সত্ত্বেও দিল্লিতে শেখ হাসিনা-মনমোহনের যৌথ ইশতেহারে সমুদ্রসীমা ইস্যুতে আলোচনার অঙ্গীকার ছিল। ১২ জানুয়ারি ২০১০ স্বাক্ষরিত ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ‘উভয় প্রধানমন্ত্রী শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে সমুদ্রসীমানা চিহ্নিতকরণে সম্মত হন। জাতিসংঘ আইনের আওতায় ইতিমধ্যেই গৃহীত কার্যপ্রণালির বিষয়টি তাঁরা উল্লেখ করেন এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে একটি প্রতিনিধিদলের সফরকে তাঁরা স্বাগত জানান।’ এবারের যৌথ বিবৃতিতে এ বিষয়ে কী কথা বলা হয়, তা জানতে আমাদের বিশেষ আগ্রহ থাকবে।
একটি বিষয় স্পষ্ট, আলোচনার টেবিলে মীমাংসা করা হবে—প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের এমন আশ্বাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক আদালত থেকে মামলা তুলে নেওয়ার ঝুঁকি নেবেন না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.