সড়ক শৃঙ্খলা-বিআরটিএ সংস্কারে কিছু সুপারিশ by মো. আলী আকবর মল্লিক

বেকারত্ব দূর করতে একজন অর্ধশিক্ষিত যুবক ড্রাইভিং পেশা বেছে নেয়। মোটরযান চালানোর জন্য যুবকটি মনস্তাত্ত্বিকভাবে উপযুক্ত কি না, তা যেমন আমলে নেওয়া হয় না, তেমনি তাকে যোগ্যতাসম্পন্ন ড্রাইভার তৈরি করার এবং তার লাইসেন্সটি যেমন হওয়ার কথা, তার আধুনিকায়ন-ব্যবস্থা বিআরটিএর নেই।
এই ‘নেই’-এর বদৌলতে বিআরটিএ একটি মোটরযান নিবন্ধন এবং প্রতিবছর ওই মোটরযানের ফিটনেস দিতে মালিককে হয়রানি, দুর্নীতি আর সুশাসনের অভাব কাকে বলে বুঝিয়ে দেয়। দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশে সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো চলতে একটি পদ্ধতি বা শৃঙ্খলা এই ৪০ বছর বয়সী দেশটিতে গড়ে ওঠেনি। এশিয়ার বহু উন্নয়নশীল দেশে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সর্বত্র একটি পদ্ধতি ও শৃঙ্খলা গড়ে উঠলেও আমরা চলছি দুই ডানা ভাঙা ইগল পাখির মতো।
বাংলাদেশে দক্ষ ড্রাইভার তৈরি হওয়ার সঠিক পদ্ধতি, ক্ষেত্র ও শৃঙ্খলা—এর কোনোটিই নেই। অবাক লাগে, খুব গুরুত্বপূর্ণ অনেক ট্রাফিক সিগন্যালের অর্থ অনেক ড্রাইভার জানে না; যেমন—মহাসড়কের ওপর যে অবিচ্ছিন্ন (সলিড) ও বিছিন্ন (ব্রোকেন) দুই ধরনের লাইন আছে, তা কী নির্দেশ করে—কয়েকজন ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে প্রায় সবার কাছ থেকে পেয়েছি ভুল ও মনগড়া উত্তর।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কারণ অনেক। তবে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও মোটরযান ফিটনেস নিয়ন্ত্রণ করে যে বিআরটিএ, তার আধুনিকীকরণ যেমন জরুরি তেমনি জরুরি একে দুর্নীতিমুক্ত করা। ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে বিআরটিএর আধুনিক ক্যাম্পাস থাকা বাঞ্ছনীয়। ঢাকারটি হবে মেইন ক্যাম্পাস। মেইন ক্যাম্পাসটি অন্তত ১০০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা দরকার। হতে পারে মাওয়া বা ময়মনসিংহ সড়ক এলাকায়। যেখানে থাকবে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ, পরীক্ষা ও লাইসেন্স প্রদানকেন্দ্র, থিয়েটার হল, মোটরযান নিরীক্ষাকেন্দ্র, গবেষণাগার ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। অন্য বিভাগীয় শহরের ক্যাম্পাসে গবেষণাগার ছাড়া আর সবই থাকবে।
লাইসেন্স প্রদান কেন্দ্র: উপযুক্ত ড্রাইভার তৈরির উদ্দেশ্যে প্রার্থী যাচাই-বাছাই (ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মানবিক গুণাবলি) এবং একটি পূর্ণাঙ্গ কোর্স সম্পন্ন করার প্রশিক্ষণকেন্দ্র থাকবে। যাচাই-বাছাই ও কোর্স এমন হবে যেন ওস্তাদের কাছ থেকে হেলপারের শেখার প্রবণতায় ভাটা পড়ে। কেন্দ্রে শ্রেণীকক্ষ থাকবে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়ার এবং ডিজাইনকৃত লুপ আকারের সড়ক থাকবে হালকা থেকে ভারী সব ধরনের মোটরযান চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার এবং পরীক্ষা নেওয়ার। কোর্স সম্পন্ন করার খরচ নির্ভর করবে প্রার্থীর দক্ষতার ওপর। হালকা গাড়ির ড্রাইভার হতে প্রয়োজন হতে পারে ৭ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। যেসব প্রার্থী কম খরচে বিআরটিএ ছাড়া অন্য কোনো ড্রাইভিং স্কুল (বিআরটিএর কয়েকটি শর্ত পূরণ সাপেক্ষে অনুমোদিত) থেকে প্রশিক্ষণ নেবে তারা যতক্ষণ পর্যন্ত পরীক্ষায় পাস করতে না পারবে, তাদের বিআরটিএর একটি আংশিক কোর্স শেষ করার সুযোগ দিতে হবে। লাইসেন্স পেতে বিআরটিএ-নিয়ন্ত্রিত লিখিত, মৌখিক, ব্যবহারিক ও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কোনো বিকল্প থাকবে না। দেশে প্রতিদিন যে কটি যানবাহন নিবন্ধিত হবে, কমবেশি সমসংখ্যক ড্রাইভার তৈরি করতে হবে, যার একটি অংশ চাকরি নিয়ে বিদেশে যাবে। ড্রাইভার বানানোর মেকানিজম তৈরি করা জরুরি।
থিয়েটার হল: পরীক্ষায় পাস করার পর যাদের নতুন লাইসেন্স দেওয়া হবে এবং যারা পুরাতন লাইসেন্স নবায়ন করবে, তাদের সবাইকে লাইসেন্স হস্তান্তরের আগে থিয়েটার হলে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে। শহরের ভেতরে বা মহাসড়কে চলতে কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটে, দুর্ঘটনার পরিণতি, কোন বিষয়ে সচেতন হলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব—এর সঙ্গে ট্রাফিক সিগন্যাল ও আইন (যা প্রশিক্ষণকেন্দ্রেও শেখানো হয়েছে) ইত্যাদি এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে থাকবে। প্রামাণ্য চলচ্চিত্র দেখানোর পর একটি শপথবাক্য পাঠ করানোর মধ্য দিয়ে লাইসেন্স হস্তান্তর করতে হবে। বাঁ হাতে লাইসেন্স ও ডান হাতের তালু বুকের বাঁ দিকে রেখে ‘জ্ঞাতসারে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করব না’ এমন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বাক্যসংবলিত শপথ পড়াতে হবে। লাইসেন্সের সঙ্গে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র সিডি এবং ট্রাফিক-সম্পর্কিত একটি রঙিন নির্দেশিকা দিতে হবে।
মোটরযান নিরীক্ষাকেন্দ্র: অবশ্যই এই কেন্দ্রে সব ধরনের মোটরযানের ফিটনেস নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। নিরীক্ষা হতে হবে ডিজিটালনির্ভর। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে ডিজিটাল পদ্ধতি এ দেশের কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ার (সিএসই) বা বিশেষজ্ঞরা তৈরি করবেন। যেমন—ইঞ্জিনে একটি হিডেন বারকোড মোটরযানটি রেজিস্ট্রেশনের সময় বিআরটিএ সেঁটে দেবে। এই বারকোডটি প্রতিবছর ফিটনেস নিরীক্ষার জন্য ব্যবহূত হবে বলে মোটরযানটিকে নিশ্চিতভাবে বিআরটিএ ঘুরে আসতে হবে। কেন্দ্রে একটি মোটর গ্যারেজও থাকবে, যেখানে সব ধরনের যানের হালকা মেরামতের কাজ করা যাবে।
গবেষণাগার: সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয় ও কমিয়ে আনা, লাইসেন্স প্রদান (প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরিসহ), মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন ও নিরীক্ষার কাজকে গতিশীল রাখা ইত্যাদির ওপর গবেষণা হবে। দুর্ঘটনার কারণসমূহ ও সড়কের ঝুঁকিপূর্ণ জোনগুলো চিহ্নিত করে এবং তার উপযুক্ত সমাধান বের করে দেশের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের দায়িত্বে নিয়োজিত বিভাগগুলোকে পরামর্শ দেবে। গবেষকেরা দেশ-বিদেশের বৃত্তি নিয়ে উন্নত দেশে উচ্চশিক্ষা ও ট্রেনিং কোর্স করতে যাবেন।
প্রশাসনিক কেন্দ্র: প্রশিক্ষণ, পরীক্ষা ও লাইসেন্স প্রদানকেন্দ্র, থিয়েটার হল, মোটরযান রেজিস্ট্রেশন ও নিরীক্ষাকেন্দ্র এবং গবেষণাগার নিয়ন্ত্রণের কাজে প্রশাসনিক কেন্দ্রে একেকটি আলাদা সেল থাকবে। যেমন—লাইসেন্সটি কেমন হবে, তা গবেষণাগারের পরামর্শ অনুসারে প্রশাসনিক কেন্দ্র তৈরি করবে।
লাইসেন্স: লাইসেন্সে একটি করে হিডেন বারকোড থাকবে, যা সিএসই বিশেষজ্ঞরা ডিজাইন করবেন। বিআরটিএ ও হাইওয়ে পুলিশের কাছে থাকা মেশিন বারকোড পড়তে পারবে। লাইসেন্সে পয়েন্ট থাকবে, যা হতে পারে ১০০। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে জরিমানার ওপর অপরাধের ধারা অনুসারে পয়েন্ট কাটার বিধান থাকবে। ৩০-এর নিচে পয়েন্ট নেমে এলে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে এবং চালককে নতুন করে পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নিতে হবে। প্রতিটি মোটরযানের পেছনে ‘হাউ ইজ মাই ড্রাইভিং’ এবং হাইওয়ে পুলিশের ‘একটি মোবাইল নম্বর’ দেওয়া থাকবে, যাতে ওই মোটরযানের ড্রাইভার ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে বা বেপরোয়া গতিতে চালালে অভিযোগ করা যায়।
বাস্তবতা হলো, ১৬ কোটি লোককে বাস করতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো ছোট্ট একটি দেশে। কম জায়গায় বেশি লোক বসবাস করতে প্রয়োজন বেশি শৃঙ্খলা ও নিয়মকানুন মেনে চলার। যেমন—দুই লেনের একটি আঁকাবাঁকা রাস্তায়ও কঠোরভাবে নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চললে দুর্ঘটনা ঘটে না। তাই ড্রাইভার ও যানবাহনের ফিটনেস দেয় যে বিআরটিএ সেই বিআরটিএর ফিটনেস ঠিক করে যোগাযোগ খাতের মূল চালিকাশক্তিকে শৃঙ্খলার আওতায় আনা অপরিহার্য।
ড. মো. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.