শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস-পারুলদের কথা by তামান্না ইসলাম অলি

রাজধানীর একটি ট্রাফিক সিগন্যাল। জ্বলে ওঠে লাল বাতি। থেমে যায় গাড়িগুলো। পারুল ছুটে বেড়ায় এক গাড়ির জানালা থেকে আরেক গাড়ির জানালায়। হাতের ফুলগুলো বিক্রি করতে হবে তাকে। বয়স কত হবে? এই ১১ থেকে ১২ বছর। যে বয়সে ওর হাতে থাকা উচিত ছিল বই, খাতা ও পেনসিল। এর পরিবর্তে ও হাতে তুলে নিয়েছে জীবিকা।


রাজধানীর ব্যস্ত রাস্তায় ও কখনো ফুল, কখনো চকোলেট আবার কখনো পপকর্ন হাতে ছুটে বেড়ায়। পারুল একজন নয়, অনেক। শুধু রাজধানীতে নয়, সারা দেশে। পারুলরা শিশুশ্রমিক। সারা দেশে পারুলদের সংখ্যা কয়েক লাখ। নানাভাবে শ্রম বিক্রির সঙ্গে ওরা জড়িত। ওদের বেশির ভাগ শ্রমই ঝুঁকিপূর্ণ। আজ বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। ১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শিশুশ্রম বন্ধ করতে এক কর্মসূচি হাতে নেয়। বর্তমানে বাংলাদেশসহ ৮০টি দেশ এ দিবসটি পালন করছে। আইএলওর হিসাবে সারা বিশ্বে প্রায় ২৪ কোটি ৬০ লাখ শিশু নানাভাবে শ্রম বিক্রি করছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে ১৮ কোটি। বাংলাদেশেও শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, আমাদের দেশে পাঁচ থেকে সাত বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৪২ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন। এর মধ্যে ৩ দশমিক ১৮ মিলিয়নই শিশুশ্রমিক। প্রত্যেক মানুষের জীবনে সবচেয়ে আনন্দঘন সময় শৈশব। এর পরও পারিবারিক প্রয়োজনে বিশ্বের অনেক শিশুকে কাজ জোগাড় করে নিতে হয়েছে। এতে হয়তো কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মৃত্যুও হয়েছে কারো কারো। এর পরও বাংলাদেশের শিশুরা এখনো কলকারখানা, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বাসাবাড়িতে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। এ ছাড়া মাদক উৎপাদন, পাচার, পর্নোগ্রাফি, যৌনকর্ম ও দাসত্বের শৃঙ্খলে আজও বন্দি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শিশুশ্রমবিরোধী আইন রয়েছে কাগজে-কলমে। যদিও এরই মধ্যে সরকার নানা সময়ে বিভিন্ন আইন প্রয়োগ করে শিশুশ্রমকে নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর পরও অনেক শিশু প্রয়োজনের তাগিদে শ্রমজীবী। কিন্তু এখন সময় এই অমানবিক পরিস্থিতি প্রতিরোধের। বাংলাদেশে প্রচলিত বিভিন্ন আইনে শিল্প-কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে শিশুশ্রম নিয়োগের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ রয়েছে। গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে শিশুশ্রম বন্ধ করতে বিজিএমইএ, ইউনিসেফ এবং আইএলও পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর আওতায় ৪২ হাজার শিশুশ্রমিককে গার্মেন্ট থেকে বের করে পড়াশোনা ও কারিগরি প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কাজের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে চট্টগ্রামের ৯টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে একটি প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে তিন হাজার শিশুকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর পরও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আর বেশির ভাগ শিশুই আজন্ম মেধাবী। আমাদের এই মেধা কাজে লাগাতে হবে। যত দরিদ্রই থাকুক, যেকোনো মূল্যে আমাদের দেশে শিশুশ্রম চিরতরে বন্ধ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। কারণ কে বলতে পারে, একজন অবহেলিত শিশুর মধ্যে আরো একজন রবীন্দ্রনাথ বা জগদীশচন্দ্র লুকিয়ে নেই?
তামান্না ইসলাম অলি

No comments

Powered by Blogger.