তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প-আগে পানিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা হোক

উত্তরাঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অনেক স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এর তীরবর্তী আটটি উপজেলার ৯৬ হাজার ৫৭৫ হেক্টর জমি 'গ্র্যাভিটি' পদ্ধতির সেচ সুবিধার আওতায় আসবে। ফলে তিন কোটি ৬০ লাখ টন অতিরিক্ত ধান উৎপাদন সম্ভব হবে।


২০০৬ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শেষ হবে ২০১০ সালে। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ২২৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। ২০১০ সালে এসে প্রকল্পের মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানো হয় এবং ব্যয় বৃদ্ধি পায় ২১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। সেই এক বছরও এ মাসেই শেষ হচ্ছে। অথচ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ অর্থের মাত্র ৩৯ দশমিক ১৯ শতাংশ ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে। তাতেও নানা রকম অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ৩৯ শতাংশ অর্থ তথা প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ হলেও এখনো স্থানীয় কৃষকরা প্রকল্পের কোনো সুবিধা পাননি। জানা গেছে, আমাদের 'অতি দক্ষ' আমলারা এখন প্রকল্পের মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। অন্যদিকে পাঁচ বছর পর পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ শুরু করার আগে তিস্তা নদীর পানিপ্রাপ্যতার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
নদীতে প্রবাহ না থাকলে যে সেচ প্রকল্প কোনো কাজে আসবে না, তা বুঝতে আমাদের পরিকল্পনা কমিশনের বাঘা বাঘা আমলাদের এত দিন লাগল কেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়। প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল বিগত জোট সরকারের আমলে। তখনই তো সেটি বোঝা উচিত ছিল। প্রকল্প গ্রহণের আগেই তিস্তার পানিপ্রাপ্যতার বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত ছিল। যা হোক, আইএমইডির প্রতিবেদনে বিলম্বে হলেও যে বোধোদয়ের পরিচয় পাওয়া গেল, তা প্রশংসনীয়। তবে এটি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি ও ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব রাখবে কি না তা বলা মুশকিল। একটি সহযোগী দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে অবশ্য কিছুটা আশাবাদ ব্যক্ত করেই বলা হয়েছে, সম্প্রতি দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধানে মতৈক্য হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের বাংলাদেশ সফরের পর আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও বলা হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আসন্ন বাংলাদেশ সফরের সময় এ ব্যাপারে চূড়ান্ত চুক্তি হতে পারে।
তিস্তার উজানে ভারতের গজলডোবা বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে নদীটিতে পানিপ্রবাহ থাকে না বললেই চলে। আবার বর্ষাকালে গজলডোবা বাঁধের সব দরজা খুলে দেওয়ার কারণে প্রায়ই তিস্তা অববাহিকায় প্রবল বন্যা হয় এবং ফসল ও জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ে ১৯৮৩ সালে একটি চুক্তি হলেও দীর্ঘদিন ধরে এর বাস্তবায়ন নেই। আশা করা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিগত ভারত সফরকালে তিস্তার পানিপ্রবাহ নিয়ে এমন একটি কার্যকর চুক্তি হবে, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা পাবে। তখনো দুই দেশের সচিব পর্যায়ের বৈঠক শেষে এমন আশ্বাসই দেওয়া হয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরকালে তিস্তার পানিবণ্টনসহ দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোর ন্যায্য সমাধান হবে।
কিন্তু ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার এ প্রবণতা কেন? আমরা আশা করি, আইএমইডির মূল্যায়নটি বিবেচনায় নিয়ে সরকার তিস্তার পানিপ্রাপ্যতার বিষয়টি আগে নিশ্চিত করবে, তারপর প্রকল্পের বাকি কাজ সম্পন্ন করবে। তাতে জনগণের অর্থের অপচয়ও অনেক কম হবে।

No comments

Powered by Blogger.