মন্ত্রিসভা-মন্ত্রীদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে না কেন! by এ কে এম জাকারিয়া

ভারত আর বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের মেয়াদ প্রায় কাছাকাছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শপথ নিয়েছেন ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আর ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং শপথ নিয়েছেন সে বছরেরই মার্চে। দুটি দেশেই জোট সরকার ক্ষমতায়। বাংলাদেশে মহাজোট আর ভারতে ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ)।


এসব মিলের বাইরে সবচেয়ে বড় যে অমিলটি আমাদের সবারই জানা তা হচ্ছে, সেখানকার পার্লামেন্ট বিরোধী দলসহ সচল ও সক্রিয়। আমাদের সংসদও সচল। নিয়ম ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে অধিবেশন বসছে, তবে বিরোধী দল ছাড়া। আরও একটি পার্থক্য আছে—মাস দুয়েকের হলেও ভারতের বর্তমান সরকার আমাদের সরকারের চেয়ে কম বয়সী। এই সময়ের মধ্যে ভারতের মন্ত্রিসভায় মোট রদবদল হয়েছে চার দফা। এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসেই হয়েছে দুই দফা। ২০০৯ সালের জানুয়ারির শুরুর দিকে আমাদের যে সরকার বা মন্ত্রিসভা হয়েছে, তাতে অবশ্য কোনো রদবদলের প্রয়োজন পড়েনি। মনমোহন সিংকে এ কাজটি করতে হয়েছে। কারণ, অনেক মন্ত্রীর কাজকর্মে তিনি খুশি থাকতে পারেননি। তাই দুই বছর পাঁচ মাস বয়সী এই সরকারে তিনি চার দফায় কিছু মন্ত্রীকে বিদায় করেছেন, কাউকে পদোন্নতি দিয়েছেন, কারও কারও ‘ডানা ছেঁটে’ দিয়েছেন। আমাদের দেশে বর্তমান সরকারের আড়াই বছরের বেশি সময়ে কোনো মন্ত্রীর কাজকর্ম প্রধানমন্ত্রীকে এমন অখুশি করেনি যে কাউকে সরিয়ে দেওয়া তো দূরে থাক, রদবদল বা কারও ‘ডানা ছেঁটে’ দেওয়ার কাজটিও করতে হয়নি।
ভারতে গত জুলাই মাসে মন্ত্রিসভায় যে রদবদল হলো, তাতে বাদ পড়েছেন সাত মন্ত্রী, এসেছেন আটজন নতুন মুখ। যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অযোগ্যতার বিবেচনায়। মন্ত্রণালয় পরিবর্তন করে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দিয়ে মেধা ও দক্ষতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে অনেককে। অদক্ষ যাঁদের বাদ দেওয়া যায়নি, তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে। একটি উদাহরণ, আইনমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন বীরাপ্পন মইলি। সরকারের কয়েকটি মামলায় সুবিধা করতে পারেননি তিনি। সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কোম্পানিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। অন্যদিকে মেধা ও যোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দক্ষ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ সালমান খুরশিদকে সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে আনা হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ে। কারণ, সামনে টু জি স্পেকট্রাম মামলাসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলায় লড়তে হবে সরকারকে। আড়াই বছরেরও কম সময়ে ভারতের মন্ত্রিসভায় এ ধরনের এই চার দফা পরিবর্তনের সাধারণ যে ব্যাখ্যা আমরা দাঁড় করাতে পারি তা হচ্ছে, সরকার অব্যাহতভাবে মন্ত্রিসভাকে দক্ষ ও কার্যকর করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যদিও ভারতের বিরোধী দলের কথায় এই পরিবর্তন হচ্ছে নতুন বোতলে পুরোনো মদ। বিরোধীদের এ সমালোচনা থাক, কিন্তু যোগ্যতা, দক্ষতা এসব বিবেচনায় নেওয়ার কারণেই তো কেউ কেউ বাদ পড়ছেন, কেউ পদোন্নতি পাচ্ছেন, কারও পদের অবনতি হচ্ছে। মন্ত্রিসভার সদস্যদের জন্য এগুলো সতর্কবার্তাও। কেউ দুর্নীতি করলে, কাজকর্ম করতে না পারলে বাদ পড়তে হবে—এই ভয়টি অন্তত ভারতীয় মন্ত্রিসভার সদস্যদের রয়েছে।
আমাদের মন্ত্রিসভা দুই বছর আট মাস ধরে অটুট-অনড় রয়েছে। সাধারণভাবে এর মানে দাঁড়ায় আমাদের মন্ত্রিসভার সব সদস্য তাঁদের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করছেন। সবচেয়ে বড় কথা যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, মন্ত্রীরা তাঁদের দায়িত্ব পালনের জন্য কঠোরভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। (দ্য ডেইলি স্টার, ২৬ আগস্ট ২০১১)। সম্প্রতি কয়েকজন মন্ত্রীর দক্ষতা-অদক্ষতার প্রশ্ন, কাজকর্ম ও কথাবার্তা নিয়ে জন-অসন্তোষের বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে, অনেক মন্ত্রীর পদত্যাগ বা সরে যাওয়ার দাবিও উঠেছে নানা মহল থেকে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভায় এখনই কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা বাতিল করে দিয়েছেন। ‘আমি মন্ত্রিসভায় তখনই পরিবর্তন আনব, যখন আমি প্রয়োজন মনে করব। কিন্তু এখনই আমি পরিবর্তন করব না।’ (দ্য ডেইলি স্টার, ২৬ আগস্ট ২০১১)।
সংবিধান মন্ত্রিসভার ব্যাপারে সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছে। ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে একটি মন্ত্রিসভা থাকিবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও সময়ে সময়ে তিনি যেরূপ স্থির করিবেন, সেই রূপ অন্যান্য মন্ত্রী লইয়া মন্ত্রিসভা গঠিত হইবে।’ (অনুচ্ছেদ ৫৫.১)। আর মন্ত্রীদের অপসারণের প্রশ্নে বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রী যেকোনো সময় কোনো মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করতে পারিবেন এবং উক্ত মন্ত্রী অনুরূপ অনুরোধ পালনে অসমর্থ হইলে তিনি রাষ্ট্রপতিকে উক্ত মন্ত্রীর নিয়োগের অবসান ঘটাইবার পরামর্শ দান করিতে পারিবেন।’ (অনুচ্ছেদ ৫৮.২)। কোনো মন্ত্রী যদি নিজের কাজের ব্যর্থতার জন্য বিবেকের তাড়নায় পদত্যাগ না করেন, তবে তাঁকে পদত্যাগ করানোর দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর। কারও মন্ত্রী থাকা না-থাকাটা যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করে, সে কারণেই মন্ত্রীদের কাজের দায়ও চূড়ান্ত বিচারে প্রধানমন্ত্রীরই। আড়াই বছরের বেশি এক মন্ত্রিসভা নিয়ে দেশ চালানোর পর প্রধানমন্ত্রীর মূল্যায়ন হচ্ছে, মন্ত্রিসভার সদস্যরা তাঁদের দায়দায়িত্বগুলো পালনে ‘কঠোর পরিশ্রম’ করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী কি আসলেই তা বিশ্বাস করেন, নাকি প্রধানমন্ত্রী ছাড়া তিনি যে একজন রাজনীতিকও, সেই রাজনীতিকের জায়গা থেকেই এমন মূল্যায়ন করেছেন? যদি ধরে নিই, প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রীদের কাজে আসলেই সন্তুষ্ট, তাহলে দরকারি প্রশ্নটি হচ্ছে জনগণ কি সব মন্ত্রীর কাজে খুশি? বা জনগণও কি প্রধানমন্ত্রীর মতো বিশ্বাস করে যে মন্ত্রিসভার সব সদস্য দায়িত্ব পালনের জন্য কঠোরভাবে কাজ করে যাচ্ছেন?
মন্ত্রিসভা গঠনের পরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীদের কাজের মূল্যায়ন করার কথা বলেছিলেন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠনের পর ১১ জানুয়ারি সচিবালয়ে মন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেই বৈঠকে দক্ষতা প্রমাণের জন্য মন্ত্রীদের ছয় মাস সময় দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছিলেন, ‘সততা ও দক্ষতার’ ঘাটতি দেখা দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ‘কেউ দক্ষ কিন্তু অসৎ, আবার কেউ সৎ কিন্তু অদক্ষ—এ রকম সমস্যা থাকলে বিদায় নিতে হবে’ (প্রথম আলো, ১২ জানুয়ারি ২০০৯)। ছয় মাস পর কাউকে বিদায় নিতে হয়নি, বিদায় করাও হয়নি। মন্ত্রীরা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর কাছে ‘যোগ্যতা’ প্রমাণ করতে পেরেছেন। আর আড়াই বছরেও যেহেতু কাউকে সরতে হয়নি, তার মানে এই মন্ত্রিসভায় ‘দক্ষ কিন্তু অসৎ’ বা ‘সৎ কিন্তু অদক্ষ’ এমন কোনো মন্ত্রী নেই। যাঁরা আছেন, সবাই ‘সৎ’ ও একই সঙ্গে ‘দক্ষ’!
কাজের মূল্যায়ন মানেই হচ্ছে কাউকে পুরস্কার কাউকে তিরস্কার। মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত থাকেন এমন বিভিন্ন সূত্রে মাঝেমধ্যে পত্রপত্রিকায় মন্ত্রিসভার কোনো কোনো সদস্যকে প্রধানমন্ত্রীর তিরস্কারের খবর বের হয়। এসব খবর পত্রিকায় প্রকাশ পেলেও এই বিষয়গুলো আসলে গোপনীয়। এই খবরগুলো সত্য হয়ে থাকলে আমাদের বুঝতে হবে যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রীদের ধমক ও শাসনের মধ্যেই রেখেছেন। কিন্তু জনগণ মনে হয় শুধু গোপনে এই ‘ধমকের’ বাইরেও কিছু দেখতে চায়। মন্ত্রীদের কাজের মূল্যায়নের প্রকাশ্য ফলাফল দেখতে চায়। কোনো মন্ত্রী কাজকর্মে কতটুকু যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন, সততায় তাঁরা কে কতটা ধোয়া তুলসী পাতার কাছাকাছি আছেন, তার একটি ধারণা জনগণের কাছে আছে। কিন্তু জনগণের ধারণা বা তাদের চাওয়ায় আসলে কিছু আসে-যায় না। রাস্তাঘাট আর যোগাযোগের যে দশা দাঁড়িয়েছিল ঈদের আগে, তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে শহীদ মিনারে ঈদ পর্যন্ত করেছেন ‘ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী জনতা’। ঈদের আগে অনেক দৌড়ঝাঁপ করে পরিস্থিতির কিছুটা সামাল দিয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী। যোগাযোগমন্ত্রীর এই ‘কঠোর’ পরিশ্রম নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীকে সন্তুষ্ট করেছে, ‘ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী জনতা’ নাম নিয়ে যাঁরা ঈদ কাটালেন শহীদ মিনারে, তাঁদের তাই সমালোচনাই করলেন তিনি। ‘তাঁরা যদি আজকেও (ঈদের দিন) বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন, আমার বিশ্বাস কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন। নিজেরা বাড়ি না গিয়ে এভাবে কথা বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা সমীচীন নয়।’ (প্রথম আলো, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১১)
উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া তথ্যে আমরা দেখতে পেলাম, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী সম্পর্কে যে ধারণা পেয়েছেন তা হচ্ছে, ‘যোগাযোগমন্ত্রীর সততায় ঘাটতি’ রয়েছে এবং তিনি যখন বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন, তখন সেই তথ্য তাঁর সরকারকেও জানিয়েছেন। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কী মনে করলেন, তাতে আমাদের কী আসে যায়! এখন আমাদের মন্ত্রিসভার সব সদস্য যেহেতু ‘সততা’ ও ‘দক্ষতার’ পরীক্ষায় পাস করে টিকে আছেন এবং প্রধানমন্ত্রীও যেহেতু সবার কাজে খুশি, সুতরাং কাউকে তিরস্কার বা শাস্তি দেওয়ার পরিস্থিতি না-হয় নেই, কিন্তু পুরস্কৃত করতে সমস্যা কোথায়? আড়াই বছরেও মন্ত্রীদের কাজের কোনো মূল্যায়ন হবে না, ‘সততা’, ‘দক্ষতা’ ও ‘কঠোর’ পরিশ্রমের জন্য তাঁরা পুরস্কৃত হবেন না, তা কী করে হয়! কোনো কোনো মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি না তুলে আসুন, আমরা মন্ত্রীদের পুরস্কৃত করার দাবি তুলি!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.