বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-দারিদ্র্যপীড়িত দেশে বিলাসী মন্ত্রী-এমপি-আমলা by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

উপর্যুক্ত শিরোনাম-সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন পত্রপত্রিকায় ইতিমধ্যে বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। ৯ জুন ২০১১ সমকাল পত্রিকায় 'মন্ত্রী-এমপিদের গাড়িবিলাস' শিরোনামে নতুন কিছু তথ্যচিত্রসংবলিত পুনর্বার একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো। বিস্ময়কর হলো, এমন সংসদ সদস্যও রয়েছেন, যাঁরা নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় নিজেদের বার্ষিক আয় উল্লেখ করেছেন অবিশ্বাস্য কম, যা গড়ে মাসিক প্রায় পাঁচ হাজার টাকারও নিচে।


অথচ তাঁরাও শুল্কমুক্ত সুবিধায় এনেছেন কোটি টাকা দামের গাড়ি! শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিলাসবহুল গাড়ি এনেছেন ১৬৫ জন মন্ত্রী-এমপি। তাঁদের মধ্যে ৬৭ জন এনেছেন পাঁচ কোটি টাকা বা এরও অধিক দামের গাড়ি! সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মধ্যে জাতীয় অনেক বিষয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য থাকলেও নিজেদের এসব স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারে মতের ক্ষেত্রে তাঁরা সহাবস্থান করেন। অনেকেরই হয়তো স্মরণে আছে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আনার অনুমতি দিলেও বিলাসবহুল গাড়ি না আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রী-এমপিদের নিরুৎসাহিত করেছিলেন। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। প্রথমে তিনি ৩০০০ সিসি গাড়ির অনুমোদন দিলেও পরে ৪০০০ সিসির গাড়ি আনতে অনুমোদন দেওয়া হয়। বিস্ময়ের সঙ্গে এ-ও লক্ষ করা গেছে, ৪০০০ সিসি বা এরও অধিক সিসির গাড়ির দিকেই ঝোঁক বেশি মন্ত্রী-এমপিদের। জোট সরকারের শাসনামলে শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিলাসবহুল গাড়ি আনা হয়েছিল ২৭৫টি, আর, মহাজোট সরকারের শাসনামলে মে, ২০১১ পর্যন্ত আনা হয়েছে ১৬৫টি। ফলে, সরকার বঞ্চিত হলো প্রায় ৫১৭ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে। পাইপলাইনে আছে আরো ৩০টি গাড়ি। শর্ত মেনে, অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করে মন্ত্রী-এমপি অর্থাৎ আমাদের এই 'ভাগ্যনিয়ন্ত্রক'রা গাড়ি আনলেও অনেকেই এসবের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন! দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এ মান্যবররা আমাদের দেশের আইনপ্রণেতা ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল ব্যক্তি হলেও তাঁদের অনেকেই আইন ও নিয়ম ভাঙার মতো কাজগুলো করছেন কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করেই! তাঁদের এ হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার মানসিকতা কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে, কোন্ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করা উচিত,_এমন প্রশ্ন রেখেছিলাম কয়েকজন সংসদ সদস্যের কাছে, কিন্তু কোনো সদুত্তর মেলেনি।
চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি এনে মন্ত্রী-এমপিদের অনেকে তা হাতবদল কিংবা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তখন এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হলেও আমাদের 'ভাগ্যনিয়ন্ত্রক' মান্যবর ওইসব মন্ত্রী-এমপি লজ্জা পাননি। তাঁদের কৃতকর্মের কারণে কোনো রকম জবাবদিহির মুখোমুখিও হতে হয়নি। বর্তমান মহাজোট সরকার এ বিষয়টি মাথায় রেখে এবার শর্তসাপেক্ষে শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আনার অনুমতি দেয়। কিন্তু অনেকেই এসব শর্তেরও ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন নানা কৌশলে। এই যদি হয় দেশের আইনপ্রণেতা, নীতিনির্ধারকদের মনমানসিকতা তাহলে তাঁরা যে রাজনীতির ধারক-বাহক সে রাজনীতির সংজ্ঞা কিভাবে নিরূপিত হবে_এটি অবশ্যই জরুরি প্রশ্ন। তবে এটুকু সত্যি, এমন চিত্র যে দেশ বা সমাজে জিইয়ে থাকে কিংবা ক্রমপুষ্ট হয় সে দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিই শুধু নয়, শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে, সাধারণ মানুষ নানা রকম বঞ্চনায় পিষ্ট হবে_এটা খুবই স্বাভাবিক। যেখানে দেশের সাধারণ মানুষ নানা পন্থায় কর দেয় এবং উত্তরোত্তর এ কর-সংস্কৃতি আশাব্যঞ্জক রূপ নিচ্ছে, সেখানে আমাদের 'বিলাসী' মন্ত্রী-এমপিরা কর দেন না। অবশ্য এবার প্রস্তাবিত বাজেটে তাঁদের বেতন বা সম্মানীর ওপর করের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁরা দেশের দারিদ্র্যসীমার অনুপাত নিয়ে কি অঙ্ক কষবেন? সত্যি বড় বিস্ময়কর এ দেশের রাজনীতির চালচিত্র এবং আরো বিস্ময়কর এ রাজনীতির ধারক-বাহক কারো কারো দায়-দায়িত্ববোধহীন, লজ্জাহীন কর্মকাণ্ড। এরই ধারাবাহিকতায় হয়তো এবার গাড়ি কিনতে সুদমুক্ত ঋণ পাচ্ছেন আমলারা। যুগ্ম সচিবরা ১৬ লাখ ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা ২০ লাখ টাকা ঋণ পাচ্ছেন গাড়ি কিনতে। এখানেই শেষ নয়, তাঁরা গাড়ি কেনার পর তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে বেতন-ভাতার সঙ্গে আরো ৩০ হাজার টাকা পাবেন! যে দেশের অসংখ্য মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, যে দেশের অগণিত মানুষ খোলা আকাশের নিচে জীবনযাপন করে, যে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে মৌলিক অধিকারগুলো 'সোনার হরিণ' সে দেশের এই যে উৎকট চিত্র তা কতটা বিবেকবোধবিরোধী, অনৈতিক, প্রশ্নবোধক_এর জবাব মেলা ভার। এ জন্যই কি রক্তস্নাত বাংলাদেশ 'সব সম্ভব'-এর দেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে? মাত্র চার দশক আগে বিপুল রক্ত খরচ আর আত্মত্যাগে 'সোনার বাংলা' গড়ার প্রত্যয়ে যে দেশটির জন্ম হয়েছিল বিশ্ব মানচিত্রে গৌরবের পতাকা উড়িয়ে সে দেশটি যে ক্রমবিবর্ণ রূপ নিল কাদের স্বেচ্ছাচারিতা, অঙ্গীকার খেলাপ আর দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডের কারণে_এসব প্রশ্নের জবাব সচেতন জনগোষ্ঠীর কাছে খুবই স্পষ্ট। শুধু এসব জানেন না, আমাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। অথচ সমৃদ্ধ দেশ, উন্নত জাতি গঠনে তাঁরা এখনো প্রতিশ্রুতি আর অঙ্গীকারের প্লাবনে সব ভাসিয়ে দেন! এ স্ববিরোধিতাকেই দেশের রাজনীতির অলিখিত মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন আমাদের কোনো কোনো 'ভাগ্যনিয়ন্ত্রক'।
আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তো এমন নয় যে আমরা ইচ্ছা করলেই বিলাসী হয়ে উঠতে পারি। এর আগে ভিআইপি বা ভিভিআইপিদের জন্য 'প্রটোকল কার' কেনার প্রস্তাব উঠেছিল। একেই তো বলে 'গরিবের ঘোড়া রোগ'। নিকট-অতীতে গাড়িবিলাসী ৯৭ আমলার ১০১টি গাড়ির পেছনে খরচ হয়েছিল কোটি কোটি টাকা। এ-সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছিল। এসব অর্থ তো যায় সরকারি কোষাগার থেকে, প্রকারান্তরে দরিদ্র জনগণের পকেট থেকে। গাড়ি, তা সে যে গাড়িই হোক না কেন, সেটা কিনতে গেলে টাকা লাগবেই। এ টাকা কোত্থেকে আসবে, কেমন করে আসবে_সেটা যেমন একটি বড় প্রশ্ন, তেমনি প্রশ্ন, রাষ্ট্রীয় খরচে গাড়ি কেনার মতো একটি অনুৎপাদনশীল কাজে এত টাকা খরচের যৌক্তিকতা নিয়েও। এই যে মন্ত্রী-এমপিরা শুল্কমুক্ত গাড়ি এনে রাষ্ট্রকে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার কাজটি সিদ্ধ করে নিলেন, এতে ক্ষতিটা হলো জনগণের। এ দেশে অর্থাভাবে অনেক প্রকল্প বন্ধ হয়ে আছে। অনেক প্রকল্পের কাজ শুরু করাই যাচ্ছে না। অসংখ্য কর্মক্ষম কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থান করা যাচ্ছে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ খাতসহ জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অনেক খাত অর্থাভাবে জনগণের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে পারছে না। সেখানে এই যে রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে পুষ্ট না করার কিংবা শূন্য করার অপপ্রবণতা তা রোধ করবে কে? অনেকেরই হয়তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরো একটি যথার্থ মন্তব্য মনে আছে। 'এমপিরা শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার পর সারা জীবন তা ব্যবহার করতে পারবেন। আর আমাদের গাড়ি পাঁচ বছর পর ফেরত দিতে হবে। তখন কী ব্যবহার করব?' শুল্কমুক্ত গাড়ির দাবিতে কয়েকজন মন্ত্রীর এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি অনানুষ্ঠানিক একটি বৈঠকে বলেছিলেন_'শুল্কমুক্ত গাড়ির দরকার হলে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে শুধু সংসদ সদস্য হয়ে গাড়ি আমদানির সুযোগ নিন।' প্রধানমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের প্রতি সমর্থনের মনোভাব দেখা গিয়েছিল গণমানুষের। আমাদের বিলাসী মন্ত্রীরা নিশ্চয়ই পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জেনেছেন, নবনির্বাচিত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিভাবে সরকারি বিলাসী গাড়ি ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করেছেন। তিনি সাধারণ গাড়িতে চড়ছেন, তাও শুধু নিরাপত্তাজনিত কারণে। নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি মুখ্য না হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো তা-ও ত্যাগ করতেন। এ রকম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংখ্যা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কম নেই। সেখানেও কোনো কোনো মন্ত্রী কিংবা ক্ষমতাবানরা বিলাসী হয়ে ওঠেন, দুর্নীতি করেন কিন্তু সে সংখ্যা নগণ্য এবং এমন কাণ্ডকীর্তি করে সহজে তাঁদের পার পাওয়ার উপায় নেই। তা ছাড়া সে দেশের বেশির ভাগ দায়িত্বশীল ব্যক্তি দায়বদ্ধতা-জবাবদিহিতা-কর্তব্যনিষ্ঠা এবং নিজেদের অবস্থানের কথা বেমালুম ভুলে থাকেন না।
এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির রেওয়াজ প্রথম চালু করেছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদের পতনের পর এ ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পরে বিএনপি সরকার গঠন করে তা আবার বহাল করে। ওই সময় গাড়ি আমদানি নিয়ে কী ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছিল তা তখন পত্রপত্রিকায় প্রকাশও পেয়েছিল। মহাজোট সরকার দুর্নীতিরোধে গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে কিছু শর্ত আরোপ করেছে বটে, কিন্তু সুযোগটি বাতিল করেনি। মহাজোট সরকারের কাছে গণমানুষের প্রত্যাশা ছিল অন্য রকম। এ সরকার বিষয়টি আবার ভেবে দেখলে গণমানুষের কল্যাণ হবে। সরকার যাতে আর রাজস্ব থেকে বঞ্চিত না হয় এ রকম পদক্ষেপ নেওয়া হবে_এ প্রত্যাশা পোষণ করেন এখনো অনেকেই। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে এমন এমপি মহোদয় খুব কমই আছেন, যাঁর ব্যক্তিগত একাধিক দামি গাড়ি নেই। যদি এমপিদের গাড়ি ব্যবহারের ব্যাপারে সরকার খুবই উদ্বিগ্ন থাকে তাহলে সংসদের পরিবহন পুলে শুল্কমুক্ত ৩০০ বা ৩৫০টি আমদানীকৃত গাড়ি রাখলেই ল্যাঠা চুকে যাওয়ার কথা। ব্যক্তিগতভাবে এ সুযোগ দেওয়ার দরকার কী? তাই মন্ত্রী-এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির আর সুযোগ না দিয়ে এ বিধানটি আরেকবার সংসদে উপস্থাপন করে ঢেলে সাজালে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। সরকার তো সংবিধান সংশোধনীসহ তাদের ভাষায় 'বৃহৎ জাতীয় স্বার্থে' অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজেই হাত দিয়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগার তথা রাজস্ব আয়ের বিষয়গুলো বিশেষভাবে আমলে নিয়ে এ ব্যাপারে নতুন বিধিবিধান প্রণয়নে প্রধানমন্ত্রী কি নিজে উদ্যোগী হবেন? বিলাসীদের বিলাসী মনোভাব যদি দমানো যায় তাহলে বছরে যে বিপুল অঙ্কের টাকা সাশ্রয় হবে তা দিয়ে জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। যে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয় ঋণের টাকায়, যে দেশের বাজেট বাস্তবায়নের অনেক কিছু নির্ভর করে দান-অনুদানের ওপর সে দেশের মন্ত্রী-এমপি-আমলাদের এতটা বিলাসী মনোভাব পোষণের অবকাশ কোথায়?

লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.