শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্ম-ভাবনা by আনিসুজ্জামান

ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষের বিশিষ্ট সাধক রামকৃষ্ণের (১৮৩৬-১৮৮৬) ধর্ম-ভাবনা নিয়েই এ লেখা। ধর্মের নানা অর্থ আছে : ব্যাপক ও সংকীর্ণ। প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যে ধর্ম ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং সেখানে ধর্মের মূল লক্ষ্য মোক্ষ ও মুক্তিলাভ করা।


আজ থেকে চলি্লশ বছরেরও কিছুকাল আগে ঢাকার রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করি এবং অদ্যাবধি এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি।
এ নিবন্ধে যখন রামকৃষ্ণের ধর্ম-ভাবনার কথা বলছি তখন ধর্মকে পরকালীন মুক্তির পথ হিসেবে গ্রহণ করছি না। এখানে আমার মূল উদ্দেশ্য জাগতিক জীবনে ধর্মের তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা উল্লেখ করা। অন্য কথায়, পরকালে বা পরজীবনে বা আত্মিক স্তরে বা স্বগত অবস্থায় মানুষের কী হবে সেটি এখানে আমার অভীষ্ট নয়। এখানে আমার মূল লক্ষ্য এ জগতে পারস্পরিক শান্তি ও সম্প্রীতিতে থাকতে হলে ধর্ম সম্পর্কে একটি পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকতে হবে। কারণ ধর্মের শেকড় মানবমনের অনেক গভীরে প্রোথিত। একে অত সহজে উপড়ে ফেলা যায় না, উচিত নয়। যেটা উপড়ে ফেলা যায়, ফেলা উচিত, সেটা হলো ধর্মের নামে কুসংস্কার_ ধর্মকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার দুষ্ট মানসিকতা ও অপপ্রয়াস।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সংক্রান্ত বিষয়াবলি নিয়ে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে চর্চা, অধ্যয়ন ও পাঠদানের পেছনে যে মৌলিক উদ্দেশ্য তা হলো উলি্লখিত বিভিন্ন পর্যায়ে পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ ও সম্প্রীতিতে ভরপুর, মধুময় ও আন্তরিক মানবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা; তা শেষ পর্যন্ত অর্জিত হচ্ছে না। একজন মানুষ অপর একজন মানুষের প্রতি বড় বেশি সন্দিগ্ধ হয়ে উঠছে। হিংসা ও ঈর্ষাসম অসুয়া বোধ তাদের তাড়া করে ফিরছে। আনন্দ ও দুঃখ, প্রাচুর্য ও দারিদ্র্য, সফলতা ও বিফলতার অনুভূতিসম বিষয়ে পরস্পরের মধ্যে কোনো সহভাগিতা, সহমর্মিতা এমনকি সহানুভূতি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। মানুষ একে অপর থেকে অন্তর ও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, যার পরিণতিতে তারা এক একটি ক্ষুদ্র বৃত্তের গণ্ডিতে ক্রমাগত আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার বিস্ময়কর, ত্বরিত তথা তাৎক্ষণিক মাধ্যম ও উপায় হস্তগত হওয়া সত্ত্বেও একজন মানুষ অপর মানুষ থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিশেষে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে বছরের পর বছর বাস করেও প্রয়োজনে আন্তরিক সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করা দূরে থাকুক, সামান্য বাক্যালাপ পর্যন্ত করছে না। দুর্বল ব্যক্তি, দল, সম্প্রদায়, জাতি ও রাষ্ট্রের ওপর সবল ব্যক্তি, দল, সম্প্রদায়, জাতি ও রাষ্ট্র তা ব্যবহার করছে। পৃথিবীতে বিরাজমান ভয়াবহ দুঃখ-দারিদ্র্য দূর করার পরিবর্তে বিপুল পরিমাণ অর্থ, অনেক মূল্যবান সময় ও মেধা মানুষের ক্ষতি, এমনকি অনেক মানুষকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু বানিয়ে বা চিহ্নিত করে তাদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এমন একটি প্রেক্ষাপটে ঠাকুর রামকৃষ্ণের ধর্মীয় ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা অনেকের কাছে বিসদৃশ ঠেকতে পারে। কিন্তু বাইরের বহুমুখী চিত্র ও জটিল কাঠামো অতিক্রম করে যদি অবস্থা ও সমস্যার গভীরতম প্রদেশে প্রবেশ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে রামকৃষ্ণ পার্থিব জগতে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সম্প্রীতিতে ভরা একটি আন্তঃমানবিক সম্পর্ক তৈরি, তা প্রতিপালন ও বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ চৈন্তিক ও আধ্যাত্মিক হাতিয়ার সরবরাহ করেছেন। অনেক প্রভাব বিস্তারকারী বক্তার বক্তৃতার শব্দসম্ভারের কুশলী উপস্থাপনা বা শক্তিমান লেখকের লেখার গাঁথুনির কাঠিন্যে সহজ-সরল অথচ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিসটি হারিয়ে যায় বা চাপা পড়ে থাকে বা সাধারণের বোধগম্য হয় না। কিন্তু ঠাকুর রামকৃষ্ণ তার স্বভাবসুলভ সরল বাক্য ব্যবহার ও সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বা তাদের বোধগম্য ও পরিচিত উদাহরণ অথবা উপমা দিয়ে তার বক্তব্যকে জীবন্ত ও বাস্তবানুকূল করে তুলতেন। এ কারণে বিশিষ্টজনদের সীমিত গণ্ডি অতিক্রম করে তার ভাবনা ও কর্ম ব্যাপক জনগণকে স্পর্শ করত। তাদের প্রভাবিত ও পরিবর্তিত করে নতুন মানুষে পরিণত করত। তার ধর্মীয় আলোচনার আরও একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে : তার বক্তব্য তার জীবনাচারের মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে উঠত।
তার ধর্মীয় ভাবনার মূল কথাগুলো রামকৃষ্ণ মিশনের স্বনামধন্য বক্তা ও লেখক স্বামী লোকেশ্বরানন্দজীর একটি লেখায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, 'তিনি [ঠাকুর রামকৃষ্ণ] বিশেষ একটি সম্প্রদায় গড়েননি। সব মানব জাতিকেই, সব মতের, সব ভাবের, সব পথের মানুষকেই শ্রীরামকৃষ্ণ যেন পরম ভালোবেসে নিয়ে যাচ্ছেন ঈশ্বরের কাছে, শাশ্বত সত্যের দিকে। সবার মধ্যেই যে দেবত্ব আছে, সে দেবত্ব বিকাশের পথকে তিনি সুগম করে দিচ্ছেন। আবার পথ একটা নয়। ভাব, রুচি, জ্ঞান, বুদ্ধি অনুসারে যেটা আমরা নিতে পারি তা-ই শ্রীরামকৃষ্ণ দিচ্ছেন। ... [তিনি] বলেছেন : 'যো সো করে তুমি ঈশ্বর লাভ কর।'
শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে অনন্ত ভাব, অনন্ত পথের ইশারা আছে। তিনি খিড়কির দরজা খুলে দিয়ে বলেছেন, এ পথ যদি ভালো লাগে, তুমি এ পথ দিয়েই এসো। আবার সদর দেউড়ি খুলে দিয়ে বলেছেন, এসো, এখান দিয়েও তুমি আসতে পার। রাজপথ হোক, অলিগলি হোক, যেদিক দিয়েই হোক আমাদের গন্তব্যস্থলে পেঁৗছতে হবে।' আমরা যদি বর্তমানে জাতিগত নিষ্পেষণ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভৌগোলিক আগ্রাসন, সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারসহ সমকালীন বিশ্বকে গ্রাস করতে উদ্যত সমকালীন বিশ্ব সমস্যাগুলোর সত্যিকার অপনোদন চাই, তাহলে আমাদের মানুষের বহুবিধ বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান করতে হবে। বিশ্বের অনেক মহৎ মানুষের চিন্তা, লেখা ও জীবনাচারে এ সত্যটি ধৃত হয়ে আছে। শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সেই মহৎ ভাব ও ভাবনার একজন বলিষ্ঠ ধারক এবং সে পথ অতিক্রম করার একজন শ্রেষ্ঠ অভিযাত্রিক। এ মহৎ ব্যক্তির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান : পরিচালক নৈতিক উন্নয়ন কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
anisuzzamanphil@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.