কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

আমাদের এক বেরসিক বন্ধু আছে, আড্ডার আলোচনায় বিষয়বস্তুর বাইরে সব সময় সে বেফাঁস কথা বলে আড্ডাটা নষ্ট করবে। তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি নিয়ে এর মধ্যে একদিন তর্ক-বিতর্কে জমে ওঠা তুমুল আড্ডায় হঠাৎ সে খাপছাড়া এক প্রশ্ন করে বসল এবং যে প্রশ্নটি সে করল তা নিয়ে সে বেশ দুর্ভাবনাতেই পড়েছে বলে মনে হলো।


প্রশ্নটি হলো, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি উঠে গেলে সুশীল সমাজের কিছু বেকার মানুষের কী হবে, যাঁরা পরবর্তী সময়ে উপদেষ্টা হওয়ার জন্য নিরপেক্ষ হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন। উপদেষ্টা হয়ে যাওয়ার পর টার্ম শেষ হলে সাবেক উপদেষ্টার সিল নিয়ে যাঁরা দেশ ও জাতিকে উন্নতমানের সবক দেবেন। আড্ডাবাজ বন্ধুরা বিরক্ত হলেও আমি কিন্তু বেআক্কেল বন্ধুটির কথাটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলাম না। গত চার দফা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সম্মানিত উপদেষ্টারা প্রায় সব ব্যাপারে নিরপেক্ষ না হলেও ডানও ভালো, বামও ভালো জাতীয় কথা বলে জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। জাতীয় সংকটে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন, পোশাকের দোকানের ফিতা কাটছেন, গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে যেকোনো অনুষ্ঠানের সামনের সারিতে বসছেন, পত্রিকায় কলাম লিখছেন। কেউ কেউ এমনই চুপচাপ যে তাঁদের নাম এবং চেহারাও আজ অনেকের মনে নেই। প্রথমবারের একজন উপদেষ্টা কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেশের রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন এবং শোনা যায়, হিজ মাস্টার্স ভয়েসের নির্দেশে লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে নিজেকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে রেডিও-টেলিভিশনে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁর নাম অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। আটের দশকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের নেতা ছিলেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিন রাজনৈতিক জোটের পাশাপাশি আমরা একসঙ্গে আন্দোলন করেছি। তখন তাঁকে কাছে থেকে দেখেছি এবং আসল চেহারা চিনতে ভুল করেছি। তাই বোধ হয়, যুব সংগ্রাম পরিষদ ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর নামকে সমর্থন দিয়ে চরম ভুল করেছিলাম। তখন বুঝিনি, পরে বুঝেছি। ভয়াবহ এক-এগারোর আগে এবং পরে আরো দুই উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দেশের রাজনীতির পায়ে কুড়াল মেরেছেন, হাসিনা-খালেদার মতো জনপ্রিয় নেতৃদ্বয়কে মাইনাস এবং দেশছাড়া করতে চেয়েছেন। দেশের ব্যবসায়ীদের যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করেছেন, 'জোর যার মুল্লুক তার' ধরনের শাসনকে দেশে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তিন 'উদ্দিন' মিলে এসব করেছেন তথাকথিত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরই ব্যানারে এবং নির্ধারিত নব্বই দিনের স্থানে পাক্কা দুই বছর ধরে। এটা ছিল গোটা জাতির আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা এবং কল্পনার বাইরে অনৈতিক অপচেষ্টা। এক-এগারোর পর 'তিন উদ্দিন জোটের' কাছে সবচেয়ে নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আওয়ামী লীগ এবং তার নেত্রী-কর্মীরা। যদিও খালেদা জিয়ার দুই সুযোগ্য পুত্রের উত্তম-মধ্যমের ব্যাপারটি সত্য, তবুও জামায়াত-বিএনপি জোট এবং তাদের নেতা-কর্মীরা তুলনামূলক কম বিপর্যস্ত হয়েছিল তিন উদ্দিনের আমলে। তাই ৬২ বছরের ঐতিহ্যবাহী জনসম্পৃক্ত ও অভিজ্ঞ আওয়ামী লীগ যে শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়ার ভুল বারবার করবে না, সেটাই স্বাভাবিক। ন্যাড়া যেমন বেলতলায় বারবার যায় না, ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, তেমনিভাবে সত্যিকারের রাজনীতিসচেতনমাত্র মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুরনো চেহারাও আর দেখতে চায় না। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশারই প্রতিফলন ঘটেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেবল সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাই জানিয়েছেন। এর চেয়ে বেশি কিছু নিজ ইচ্ছায়, জোর করে চাপিয়ে দেননি। তাহলে তাঁর দোষটা কোথায়? তাঁকে সব দোষে দোষী করার চেষ্টা চলছে কেন! তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে হরতালই বা ডাকা হয় কেন! হরতালের নামে নৃশংস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করে সাধারণ মানুষের মনে ডর সৃষ্টি করা হচ্ছে কেন! হরতালকে 'ডরতাল' বানিয়ে দেশকে সহিংসতার পথে নিয়ে কোন অসৎ উদ্দেশ্য সাধন করতে চায় বিএনপি-জামায়াত! এ রকম 'ডরতাল' করে কি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিঘ্ন ঘটানো যাবে! রায় দিলেন আদালত আর অভিযুক্ত হলেন শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে আদালতের রায়কে অস্বীকৃতি জানিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত করে গলাবাজি করা তো আদালত অবমাননারই শামিল। বৃহত্তর বিরোধী দলের কাছ থেকে এ ধরনের শিক্ষা পেয়ে তো সাধারণ মানুষ দেশের বিচার বিভাগকে অবজ্ঞা ও অসম্মান করার দুঃসাহস দেখাবে। সেটা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলবার্তা বয়ে আনবে না। অথচ প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা কিন্তু বারবার বিরোধী দলকে আলোচনায় আসতে অনুরোধ করছেন। জাতীয় সংসদে গিয়ে বিকল্প প্রস্তাব কিংবা সংবিধান সংশোধনে যৌক্তিক মতামত ও পরামর্শ দিতে বলছেন। সমর্থক ভোটারদের ইচ্ছাকে অবজ্ঞা করে বিরোধী দলের নেতারা যেন কবির ভাষায় বলতে চান_'যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো!' আচ্ছা, সংসদে না হয় না-ই বা গেলেন, সংবাদ সম্মেলন করেও তো তাঁরা তাঁদের মতামত, পরামর্শ এবং সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে পারেন। মানুষ তো জানতে চায়, স্পষ্টভাবে বুঝতে চায় বিরোধী দলের প্রস্তাবের যৌক্তিকতা। আগেই বলেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার নয়, এটা উচ্চ আদালতের রায়। সংসদে বসে আলোচনা-তর্ক-ঝগড়া করে এ ব্যাপারে ঐকমত্যে পেঁৗছালে দেশ, মানুষ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির লাভ বই ক্ষতি হবে না। নব্বইয়ের গণজোয়ারে এরশাদের পতন হলে সময় ও জাতির প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন বিএনপি মাগুরায় উপনির্বাচন এবং পরবর্তী সময়ে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিকে আমলে নেয়নি। তাঁদের নেত্রী বলেছেন, শিশু ও পাগল ছাড়া কেউ নাকি নিরপেক্ষ নয়। নব্বইয়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি যে দেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও ভাবমূর্তির পরিপন্থী, এ কথা অনেকেই বলেছেন। কথাটা তো সত্য। দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা, যোগ্যতা, সর্বোপরি অহংকারের ঐতিহ্য কি তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির ফলে চরম অবজ্ঞার নয়! সম্পূর্ণ স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনকে ফিরিয়ে আনা না যায় তবে দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে না। গণতন্ত্রও মুখ থুবড়ে পড়বে। দেশের চার দফায় যাঁরা উপদেষ্টা হয়েছেন এবং নামের পাশে 'সাবেক' শব্দ জুড়ে কুলীন হয়েছেন অথবা যাঁরা তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিলে উপদেষ্টা হওয়ায় বঞ্চিত হবেন, তাঁরা কিন্তু এ ব্যাপারে ঝেড়ে কাশছেন না। তাদের ভাবটা এমন যে জলে নামব অথচ চুল ভেজাব না। কেউ কেউ অবশ্য কবি শামসুর রাহমানের কবিতার আদলে শিরোনাম লেখা কলামে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিকে ফিরিয়ে আনার পক্ষে শক্ত যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। তবে কি তারা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড় করাবার পক্ষে নন! বর্তমান সরকারের আমলে যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেখানে তো সরকারবিরোধী দলগুলোর প্রার্থী প্রত্যাশার বাইরে অনেক ভালো ফল করে জয়ী হয়েছেন। তবে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপের ভয় কেন! ব্যাপারটা ভাবা দরকার।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.