বিশেষ সাক্ষাত্কার-আমাদের একটি ভাষাপরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন by আনিসুজ্জামান

আনিসুজ্জামান। কৃতবিদ্য লেখক ও শিক্ষাবিদ। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। একই সঙ্গে তিনি বাংলা একাডেমীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক থাকাকালে তাঁর অভিসন্দর্ভ বাঙলা সাহিত্যে মুসলিম মানস আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।


বাংলা সাহিত্য ও সমাজ নিয়ে তাঁর গবেষণা দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমাদৃত হয়েছে। তাঁর সম্পাদনায় বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হচ্ছে পাঁচ খণ্ডে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (ইতিমধ্যে দুই খণ্ড প্রকাশিত)। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী এই শিক্ষাবিদ বাংলাদেশের সংবিধান বাংলায় ভাষান্তর করেছেন। লিখেছেন স্বরূপের সন্ধানে, পুরনো বাংলা গদ্য, আমার একাত্তর ও কাল নিরবধির মতো পাঠকনন্দিত বই। গতকাল ১৮ ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁর ৭৫তম জন্মবার্ষিকী। প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাত্কারে তিনি ভাষা আন্দোলন, বাংলা ভাষার ব্যবহার ও গতি-প্রকৃতি নিয়ে কথা বলেছেন।
 সাক্ষাত্কার নিয়েছেন: সাজ্জাদ শরিফ ও সোহরাব হাসান

প্রথম আলো  আমরা ভাষা আন্দোলনের ৬০ বছরপূর্তি পালন করছি—যে আন্দোলনের সঙ্গে আপনিও যুক্ত ছিলেন। পেছনের দিকে ফিরে তাকালে কী মনে হয়?
আনিসুজ্জামান  আমার জীবনের বড় সৌভাগ্য যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ—দুটি ঘটনার সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিলাম, যত ক্ষুদ্র পরিসরেই হোক না কেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের দিকে ফিরে তাকালে একটা তফাত দেখতে পাই যে সে সময়ে বাংলা ভাষাকে যেভাবে জীবনের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম, সেই সংকল্পের দৃঢ়তা এখন নেই। এখনো হয়তো বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের আবেগ আছে, কিন্তু সেটি তখনকার সঙ্গে তুলনীয় নয়। একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা আমাদের জীবনকে পাল্টে দিল। এখন সেটি যতটা স্মৃতি হয়ে আছে, ততটা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে নেই।
প্রথম আলো  ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা কী অর্জন করলাম?
আনিসুজ্জামান  অর্জন তো আছেই। এই যে একুশে ফেব্রুয়ারি মানুষ ভাষার জন্য আত্মোত্সর্গ করল; তারপর প্রতিবছর আমরা সেই দিবসটি পালন করি। একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় দিবসে পরিণত হলো, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আগেই। তারপর একসময় দোকানপাট ও গাড়ির নম্বর বাংলায় লেখা হলো। মনে আছে, সাংবাদিক এবিএম মূসা গাড়ির নম্বর বাংলায় লেখায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। সরদার জয়েনউদ্দীন ব্যাংকের চেকে বাংলায় সই দিতেন। এ নিয়েও ঝামেলা হয়েছিল। তখন প্রত্যেকেই মনে করতেন, ভাষা তাঁর অস্তিত্বের অংশ।
প্রথম আলো  পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তিতে যে মুক্তিযুদ্ধ হলো, তার ওপরও একুশের বিশেষ প্রভাব ছিল?
আনিসুজ্জামান  নিশ্চয়ই। আমি তো বলি, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের গণতন্ত্র শিখেয়েছে। আমরা কিন্তু শুধু বাংলা ভাষাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলিনি। বলেছি, বাংলাকে রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। অর্থাত্ অন্য ভাষাভাষী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছি। পাকিস্তানি শাসকেরা প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক ছিল বলেই বাংলাকে মুসলমানদের ভাষা হিসেবে মানতে চায়নি। তারা বলত, ওটি হিন্দুদের ভাষা। বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে তাই আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিচয় দিয়েছি, একুশ আমাদের ঐতিহ্য-সচেতনতা শিখিয়েছে। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের উদ্যোগে যে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সপ্তাহ পালিত হয় তাতে দেখলাম, শহরের সব লোক জড়ো হলো। তারা প্রদর্শনী দেখছে, বাংলা হরফের বিবর্তন দেখছে, চর্যাপদ থেকে আধুনিক বাংলা কবিতার আবৃত্তি হয়েছে—আগ্রহভরে শুনছে। এর মাধ্যমেও বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। এই সূত্র ধরেই জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটল। এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা যখন যুক্ত হলো, তখনই তা মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হলো।
প্রথম আলো  আমাদের সংবিধানে লেখা আছে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ এ কথার মাধ্যমে জাতির কোন আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছিল? তা কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে?
আনিসুজ্জামান  এটি ছিল ঘোষণা, সমগ্র জাতির প্রত্যয়। ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ বলার অর্থ হলো—যেদিন সংবিধান চালু হলো, সেদিনই রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়ে গেল।
প্রথম আলো  কিন্তু তা কি হলো?
আনিসুজ্জামান  না, তা হলো না। এর একটি কারণ, বাঙালি যখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, তখন তারা সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে; কিন্তু চ্যালেঞ্জ না থাকলে বোধ হয় পারে না। পাকিস্তান আমলে শাসকেরা যখন বৈজ্ঞানিক পরিভাষা আছে কি না, প্রশাসনিক পরিভাষা আছে কি না, জানতে চাইল, তখন কিন্তু বাঙালি লেখক-বুদ্ধিজীবীরা তা করে ফেললেন। ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা স্নাতক শ্রেণীর জন্য রসায়নের পাঠ্যবই লিখলেন। ড. এ কে এম আবদুল ওয়াহেদ ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। অবসর নেওয়ার পর বাংলায় চিকিত্সাবিষয়ক বই লিখলেন। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর উচ্চশিক্ষার পাঠ্যবই সেভাবে এগোল না। পাঠ্যবই না হওয়ায় বাংলায় উচ্চশিক্ষার বিষয়টিও বাধাগ্রস্ত হল।
এসব বিষয়ে যাঁরা বিজ্ঞ ব্যক্তি, তাঁরা এগিয়ে আসছেন না। তাঁরা এগিয়ে এলেও বাংলায় লেখার জন্য সহযোগী পাচ্ছেন না। এটি বড় সমস্যা। বাংলায় পাঠ্যবই ইত্যাদি রচনার জন্য পাকিস্তান আমলে যে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সেটি থাকলে হয়তো কাজটা এগোত। আবার বাংলা একাডেমীর পাঠ্যপুস্তক বিভাগও কাজটি করতে পারত। ইংরেজি বই পড়ে বাংলায় পড়ানো সম্ভব হয়নি নানা কারণে।
বিষয়টি এমন নয় যে আমরা বাংলার প্রতি জোর দিতে গিয়ে ইংরেজিকে অবহেলা করেছি। বরং সব মিলিয়ে শিক্ষার মানটা পড়ে গেল। স্বাধীনতার পর দুই বছর অর্ধেক পাঠ্যক্রমে পরীক্ষাও এর অন্যতম কারণ।
প্রথম আলো  স্বাধীনতার পর সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কি না। না এটি কাগজেকলমেই সীমাবদ্ধ ছিল?
আনিসুজ্জামান  সরকার অন্তত দুটো পরিপত্র দিয়েছিল। যাতে বলা হয়েছিল, সরকারি নথিপত্র বাংলায় লিখতে হবে। না লিখলে দণ্ড পেতে হবে বলে নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। তারপর এরশাদের আমলে তো সরকারি অফিসে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলো। বাংলা প্রচলন সেল করা হলো। কিন্তু সমস্যাটি হলো অন্যত্র। যেমন, আমাদের দেশে বরাবর নিম্ন আদালতে ইংরেজি-বাংলা দুটোই চালু ছিল। স্বাধীনতার পর নিম্ন আদালতে শুধু বাংলা ব্যবহূত হতো। কিন্তু হামিদুল হক চৌধুরী, যিনি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন, আশির দশকে দেশে ফিরে হাইকোর্টে এর বিরুদ্ধে মামলা করলেন। আদালতও তাঁর পক্ষে রায় দিলেন। তখন নতুন করে নিম্ন আদালতেও ইংরেজি চালু হলো। অন্যদিকে উচ্চ আদালতে আপিল বিভাগের কোনো বিচারকই বাংলায় রায় লিখতে রাজি হলেন না। যদিও হাইকোর্ট বিভাগে তিন-চারজন বিচারক বাংলায় রায় লিখেছেন। আর কেউ এগিয়ে এলেন না। যুক্তি দেখানো হলো, এসব রায় অন্যান্য দেশে নজির হিসেবে দেখানো হবে বলে ইংরেজিতে লেখা প্রয়োজন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও আদালত বললেন যে সেখানে ইংরেজি ব্যবহার করতে হবে—এটি স্বাভাবিকই মনে হয়নি। সাধারণ মানুষের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। ৭৩-৭৪ সালে পাকিস্তান থেকে আটকে পড়া বাঙালিরা ফিরে আসার পর বললেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা তো বাংলা জানে না। তাদের জন্য ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রথম আলো  সম্প্রতি সমরেশ মজুমদার এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, বাংলাদেশের পাঠকদের পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের ভাষা বুঝতে অসুবিধা না হলেও পশ্চিমবঙ্গের পাঠকেরা বাংলাদেশের লেখকদের ভাষা, বিশেষ করে মুসলমান আত্মীয় সম্পর্কগুলো বুঝতে পারে না। এতে দুই বঙ্গের ভাষা এক হলেও তাদের প্রকাশভঙ্গি আলাদা হয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে কি না?
আনিসুজ্জামান  মুসলমান আত্মীয়তাবাচক শব্দ এখনও হিন্দু বাঙালির কাছে অপরিচিত। উত্তর আমেরিকায় বিভিন্ন সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের প্রবাসীদের বলতে শুনেছি, আপনাদের (বাংলাদেশের) বইয়ে যেসব ধর্মীয় বা আত্মীয়তাবাচক শব্দ লেখা থাকে, তা আমরা বুঝতে পারি না। বইয়ের শেষে যদি শব্দের অর্থ লিখে দেন, আমাদের জন্য সুবিধা হয়। আমার জবাব দেওয়ার আগেই সমরেশ মজুমদার প্রবলভাবে আপত্তি করলেন এবং বললেন, ‘কেন, আমরা যখন হিন্দু আত্মীয়তাবাচক বা ধর্মীয় শব্দ ব্যবহার করি, তখন কি তার শব্দার্থ লিখে দিই?’
তবে কলকাতার বাঙালি পাঠকেরা মুসলমানদের অনেক কিছু জানে। সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের লেখায় ইসলাম ধর্মের শব্দ প্রচুর আছে। এতে পশ্চিমবঙ্গের পাঠকেরা আপত্তি করছে বলে মনে হয়না। তবে জানা-বোঝার ঘাটতি আমাদের দিক থেকেও আছে। আমি মনে করি, দুই দেশের সাহিত্যের আদান প্রদান বাড়লে এ সমস্যা অনেকটাই কেটে যাবে। কিন্তু সেখানেও বাধা আছে। আমাদের পুস্তকবিক্রেতারা পশ্চিমবঙ্গের বই আনলেও পশ্চিমবঙ্গের পুস্তকবিক্রেতারা আমাদের বই নিতে খুব একটা আগ্রহী নন। একবার ওখানকার এক নামকরা প্রকাশক বলেছিলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের বই আনব না। যদি বাংলাদেশের লেখকদের বইয়ের চাহিদা এখানে থাকে তবে আমরা এখানে তা ছাপব।’ যদিও বাংলাদেশের অনেক লেখকের বই পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু সেই অর্থে আদান-প্রদানটা কম হচ্ছে।
প্রথম আলো  অতীতের পূর্ববঙ্গ বা বর্তমানের বাংলাদেশের ভাষার কি আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য সব সময়ই ছিল না?
আনিসুজ্জামান  আমি যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস পড়ি, তখন তেমন পার্থক্য লক্ষ করিনা। কিন্তু হয়তো অন্য কোনো লেখকের লেখায় এই পার্থক্যটা ধরা পড়ে। কলকাতার সংবাদপত্রে কিন্তু আমাদের এখানকার সংবাদপত্রের চেয়ে বেশি আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করে। তার পরও বলব, সাহিত্যে একটা পার্থক্য আছে। পশ্চিমবঙ্গের যে জীবনযাত্রা, যে রাজনীতি, যে অর্থনীতি তা আমাদের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি, রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফলে সমাজের যে ছবিটি সাহিত্যে পাওয়া যাচ্ছে, তা অভিন্ন নয়।
অন্যদিকে যে আত্মীয়তাবাচক শব্দের কথা বললাম, তাতে পার্থক্য আছে। আমাদের এখানে সাহিত্যে আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার বাড়ছে, পশ্চিমবঙ্গে আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার একেবারেই কম। ওখানকার পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন সালের বইয়েও রাঢ় অঞ্চলের ভাষা ব্যবহূত হতো, এখন হয় না। আমাদের এখানে আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার শুরু হয়েছিল উপন্যাসে, নাটকে; পরে সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও বিস্তৃত হয়। জসীমউদ্দীন ও আল মাহমুদের কবিতায় প্রচুর আঞ্চলিক শব্দ থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের বইয়ের প্রচুর পাঠক আছে।
অসুবিধা হলো, যখন আমরা জোর করে বলতে চাই যে আমরা এক শ বছর আগের ভাগীরথীর তীরবর্তী বাংলাকে কেন প্রমিত বাংলা হিসেবে মানব। এর মধ্যে একটা রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে। আমরা যদি বলি বুড়িগঙ্গার তীরের মানুষের ভাষাকেই প্রমিত বাংলা করতে হবে, তার যৌক্তিক পরিণতি কী হবে? তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্র, নজরুল ইসলামের লেখাকে আমাদের বাংলা বলে স্বীকার করব না? আমরা যদি ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিবেচনার ওপর জোর দিই তাহলে একসময় দুটো ভাষা হয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের জন্যও তো একটি প্রমিত বাংলা তৈরি করতে পারিনি। জামায়াত নেতা গোলাম আযম লিখেছিলেন, ‘আমার ভাষার নাম বাংলাদেশি ভাষা।’ কিন্তু তা কেউ গ্রহণ করেনি। এখন যাঁরা বলছেন, আমাদের আঞ্চলিক ভাষার ভিত্তিতে লিখিত ভাষা চলতে হবে, তাঁরা বাংলাদেশি ভাষাকেই বোঝাচ্ছেন। ষাটের দশকে যে কথা আবুল মনসুর আহমদ, ইব্রাহিম খাঁ, আবুল হাশিমরা বলতেন; আধুনিকদের কাছ থেকেও সেই দাবি উঠেছে।
আমি মনে করি, সাহিত্যের প্রয়োজনে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার চলতে পারে। কিন্তু আঞ্চলিক ভাষা কোনো দেশেই প্রমিত ভাষার জায়গাটা নিতে পারে না।
প্রথম আলো  মান বাংলা নিয়ে এখন প্রবল বিতর্ক চলছে। বাংলাদেশের ব্যবহার্য বাংলা ভাষাকে আলাদা করার যে দাবি কেউ কেউ করছেন, তার মধ্যে হয়তো রাষ্ট্রীয় এককেন্দ্রিকতা ভাষার একটি সুপ্ত বাসনাও আছে। এর জন্য কি বহু আগেই একটি ভাষাপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল?
আনিসুজ্জামান  প্রয়োজন অবশ্যই ছিল। এখনো নেওয়া যায়। এই যে ভাষাব্যবহারের ভিন্নতা আছে, পরিকল্পনার মাধ্যমে তা কমিয়ে আনা যেতে পারে। লন্ডনপ্রবাসী এক বাঙালি একবার আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আপনি মাতৃভাষার শিক্ষার কথা বলছেন। আমাদের মাতৃভাষা সিলেটি। আমরা কেন সিলেটি ভাষায় শিক্ষা নিতে পারব না?’ আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত আঞ্চলিক ও প্রমিত বাংলার পার্থক্য করতে না পারব ততক্ষণ এ সমস্যা থাকবে। আমরা বাড়িতে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে থাকলেও কিন্তু বাইরে সেটি পরি না। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে নেওয়া ঠিক নয়।
প্রথম আলো  ভাষার সঙ্গে জাতীয়তাবোধের একটি সম্পর্ক আছে। আবার ভাষা পরিকল্পনা নিলে অন্যান্য ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার কোনো বিরোধ তৈরি হবে কি না?
আনিসুজ্জামান  যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাষাপরিকল্পনা নেওয়া হয়, তাতে বাংলা ছাড়া অন্যান্য ভাষার মর্যাদা কী হবে, সেসব ভাষার কী কাজ হবে, তা নির্ধারণ করতে পারলে কোনো সমস্যা হবে না। আজ হয়তো আমরা চাকমা ও গারো ভাষায় পাঠ্যবই তৈরি করতে পারছি না, কিন্তু ভবিষ্যতে এটি অসম্ভব নয়। সাঁওতাল ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ইতিমধ্যে চালু আছে।
ভাষাপরিকল্পনার প্রথম কথা হবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা। কেননা, আমরা সংবিধান থেকে তো দূরে যেতে পারব না। আমরা দ্বিতীয় ভাষা কী শিখব, কোন পর্যন্ত শিখব তা পরিকল্পনায় থাকবে। এরপর আসবে দেশের অন্যান্য ভাষার বিকাশে কী পদক্ষেপ নিতে পারি। এই তিনটি বিষয় মাথায় রেখে আমাদের প্রাথমিকভাবে এগোতে হবে।
প্রথম আলো  যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের মান বা প্রমিত বাংলাই ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু ভাষাপরিকল্পনায় বাংলায় অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ আমদানির ওপর জোর দিলে বাড়তি কোনো চাপ সৃষ্টি করবে কি না?
আনিসুজ্জামান  যদি স্বাভাবিকভাবে কোনো শব্দ আসে আপত্তি নেই। কিন্তু জোর করে শব্দ আনা, কিংবা আইয়ুব খানের মতো কিছু উর্দু, কিছু বাংলা মিলিয়ে একটি সংকর ভাষা তৈরি করা ঠিক হবে না। ভারতও হিন্দিকে কিন্তু যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে দাঁড় করাতে পারেনি। হিন্দির প্রসার ঘটেছে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। যার প্রভাব এখন বাংলাদেশেও পড়েছে। আমার বাড়ির উল্টো দিকের একটি রেস্তোরাঁর নাম দিয়েছে ‘আপকে রোটি চাওল আওর গোশত’। পাকিস্তান আমলেও কিন্তু কোনো রেস্তোরাঁর এ ধরনের নাম ছিল না। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দিকে যেখানে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, সেখানে নিতে পারেনি। বরং সারা ভারতে ইংরেজির প্রসার বেড়েছে, তা যোগাযোগের সাধারণ মাধ্যম হয়েছে।
প্রথম আলো  আপনি হিন্দির প্রভাবের কথা বলেছেন। ভাষা তো কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এর সঙ্গে জীবনযাপন, সংস্কৃতি, রাজনীতিও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এতে বাংলা ভাষার ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?
আনিসুজ্জামান  বাংলা ভাষা বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা এ উত্স থেকেই সবচেয়ে বেশি। আঞ্চলিক ভাষা থেকে বিকৃতির সম্ভাবনা ততটা নয়। আরেকটি বিষয়, পাকিস্তানি শাসকেরা উর্দু আমাদের ওপর চাপাতে চেয়েছিল। আর হিন্দি এসেছে বিনোদনের মধ্য দিয়ে। একসময়ে কিন্তু বাংলাদেশের টিভি নাটক পশ্চিমবঙ্গে বেশ জনপ্রিয় ছিল। এখন উল্টো বাতাস বইতে শুরু করেছে বলেই আমাদের শঙ্কা জাগে। তাই বলে আমরা জানালা বন্ধ করে দেব না, নিজেদের সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। হিন্দি ভাষার প্রভাব যে বিপজ্জনক, সে কথাটিও স্পষ্ট জানাতে হবে। আমাদের টিভি অনুষ্ঠানের মানও বাড়াতে হবে।
প্রথম আলো  বাংলা ভাষা ব্যবহারে যে অরাজকতা চলছে, বিশেষ করে গণমাধ্যমে, তা অপনোদনের উপায় কী?
আনিসুজ্জামান  অরাজকতা নানা ধরনের। শব্দব্যবহারে অরাজকতা একটি। একটি ছোট উদাহরণ দিই। ‘অন্যতম’ শব্দের অর্থ ‘অনেকের মধ্যে একজন’। কিন্তু পত্রপত্রিকায় লেখা হয় ‘অন্যতম একটি কারণ’। ভুল বানান, ভুল বাক্য ব্যবহার এবং ইংরেজি শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে। এফএম রেডিওতে হিন্দি, ইংরেজি ও বাংলার মিশেলে এক ধরনের জগাখিচুড়ি ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা যেমন তরুণদের লক্ষ করে এসব ভাষা ব্যবহার করছে, তেমনি তরুণেরাও মনে করছে, এটাই তাদের শিখতে হবে। মোবাইল ফোনে যে ইংরেজি ব্যবহার করা হয়, সেটি কিন্তু লিখিত ইংরেজি ভাষা নয়। মৌখিক ভাষা, আড্ডার ভাষা এসবের মাধ্যমে বন্ধুদের সঙ্গে মতবিনিময় করা যায়। কিন্তু আমরা এটাকেই যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছি। বানানের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনা প্রয়োজন। প্রথম আলো যেমন ভাষারীতি চালু করেছে, অন্যান্য পত্রিকাও তা করতে পারে। কিন্তু বানান ইত্যাদির ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন রীতি অনুসরণ বাঞ্ছনীয় নয়।
প্রথম আলো  বাংলা ভাষার গবেষণা ও বিকাশের লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা একাডেমী। সেই লক্ষ্যে তারা কতটা স্থির আছে?
আনিসুজ্জামান  বাংলা একাডেমী গবেষণার ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারেনি। একে লক্ষ্যচ্যুতি বলা যেতে পারে। বাংলা একাডেমীর প্রথম বৃত্তিপ্রাপ্ত গবেষক ছিলাম আমি, কিন্তু আমিও এক বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাই, যদিও গবেষণার কাজটি শেষ করেছিলাম। আরও অনেকে গবেষণা করেছিলেন। আবার অনেকে শেষ করেননি। পরে গবেষণা বৃত্তি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বাংলা একাডেমীতে নিজস্ব পরিকল্পনায় গবেষণাকাজ তেমন হয়নি। প্রমিত বাংলা ব্যাকরণকে একাডেমীর নিজস্ব গবেষণা বলা যেতে পারে। এর আগে আঞ্চলিক অভিধান তৈরি করেছিল। আরেকটি কাজ হয়েছে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। অভিধানের জন্য আলাদা সেল থাকলে বিদেশি শব্দ, মুখের শব্দ নিয়মিত অভিধানে যোগ হতে পারত। জীবনী সংকলনের জন্যও এমন সেল দরকার।
প্রথম আলো  হতাশার কথা বললেন, আশার জায়গা কোথায়?
আনিসুজ্জামান  আমি বলব বাংলা ভাষা প্রয়োগের দিকটি হতাশাজনক হলেও বিকাশের দিকটি হতাশাজনক নয়। গত ৫০ বছর আমাদের সাহিত্যের পরিধি বেড়েছে, প্রচুর বই বেরুচ্ছে, চর্চার ক্ষেত্র বেড়েছে। এত লেখক সৃষ্টি হয়েছে, তাও কম কথা নয়। আমাদের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গ যেখানে এগিয়ে আছে তা হলো, সেখানে নানা ভাষা জানা লোক অনেক বেশি। স্প্যানিশ, পর্তুগিজ থেকে আফ্রিকান ভাষা জানা লোক রয়েছে। আমরা এখানে ইংরেজির বাইরে তেমন কিছু জানি না।
প্রথম আলো  আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আনিসুজ্জামান  আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.