একুশে স্মরণে-প্রথম প্রকাশ

আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে যাঁর যাঁর অবস্থানে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত। বিভিন্ন প্রজন্মের এই কথাসাহিত্যিকেরা বলেছেন তাঁদের প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা-অনুভূতি লেখক হওয়ার স্বপ্ন থেকে বই প্রকাশ করিনি সেলিনা হোসেন ১৯৬৯ সালে আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয়। বইটির নাম উৎস থেকে নিরন্তর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় গল্প লেখার অভ্যাস ছিল।


বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে লেখা ১৪টি গল্প নিয়ে এই গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বইটি প্রকাশ করার বিষয়ে সবচেয়ে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন আমার শিক্ষক আবদুল হাফিজ। তিনি আমাকে বললেন, ‘তোমার লেখা দিয়ে বই বের করো। কর্মজীবনে কাজে লাগবে। তোমার যোগ্যতার পাল্লাকে ভারী করবে।’ বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে স্যারের সাহায্যে বইটি প্রকাশ করেছিলাম। পরবর্তী সময় ২০০৯ সালে ইত্যাদি প্রকাশনী থেকে বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশ করা হয়। উৎস থেকে নিরন্তর প্রকাশিত হওয়ার পর আবদুল হাফিজ স্যার বইটি মুনীর চৌধুরীর কাছে পাঠিয়ে দেন। তিনি সে সময় ঢাকা টেলিভিশনে নতুন বইয়ের রিভিউ নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করতেন। ওই অনুষ্ঠানে আমার বইটির প্রশংসা করেন। ১৯৭০ সালে মুনীর চৌধুরীকে প্রথম ও শেষবারের মতো দেখার সুযোগ হয়। হুমায়ুন আজাদ আমার একটিমাত্র বইয়ের রিভিউ করেছিলেন। সেটি হলো উৎস থেকে নিরন্তর। আসলে লেখক হওয়ার স্বপ্ন থেকে বই প্রকাশ করিনি। মনে হয়েছিল এটি আমাকে চাকরি পেতে সাহায্য করবে। জীবনবৃত্তান্তে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

ভাবতাম বইমেলায় বই এলেই বুঝি বিক্রি হয়ে যায়
শাহীন আখতার
শ্রীমতীর জীবনদর্শন আমার প্রথম বই। ১৯৯৭ সালের একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়। দৈনিক সংবাদ-এর সাহিত্য পাতায় ১৯৯১ সাল থেকে গল্প লিখতাম। ছয় বছর ধরে এ পত্রিকায় লেখা ১২টি গল্প নিয়ে শ্রীমতীর জীবনদর্শন। তখন অবশ্য বই প্রকাশ করার কথা ভাবিনি। লিখতে ভালো লাগত, তাই গল্প পাঠাতাম। দৈনিক সংবাদ-এর সে সময়ের সাহিত্য পাতার সম্পাদক ছিলেন আবুল হাসনাত। তিনি আমার পাণ্ডুলিপি ‘সাহিত্য প্রকাশ’ প্রকাশনীর কাছে পাঠিয়ে দেন। মনে একধরনের আলোড়ন চলেছে তখন। একুশের বইমেলায় প্রথম বই প্রকাশিত হবে—এই আনন্দটা অন্যরকম। সাহিত্য প্রকাশ এটি প্রকাশ করতে রাজি হয়েছে, খবরটি খুব অপ্রত্যাশিত ছিল আমার কাছে। মনে মনে ভাবতাম, বইমেলায় বই প্রকাশিত হলেই বুঝি বিক্রি হয়ে যায়। পরে বিষয়টি বুঝতে পারি। বইমেলা শেষ হয়ে যায়। তেমন একটা বই বিক্রি হয়নি। কিন্তু ধীরে ধীরে সাড়া পেতে থাকি পাঠকের কাছ থেকে।

প্রথম প্রকাশিত হয় গবেষণা গ্রন্থ
অদিতি ফাল্গুনী
প্রথম একক গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালের একুশের বইমেলায়। বইটির নাম ছিল বেশ লম্বা, বাংলার নারী সংগ্রামী: ঐতিহ্যের অনুসন্ধান। বইটি ১৯৯৭ সালে লিখেছিলাম। এটি একটি গবেষণাগ্রন্থ। এর বিষয়বস্তু ছিল মূলত ভারত উপমহাদেশে বৈদিক সময়কাল থেকে আজ পর্যন্ত নারীর রাজনৈতিক সংগ্রামের একটি সারসংক্ষেপ। তখন সম্মান শেষ বর্ষের ছাত্রী আমি। ‘স্টেপস্ টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট’ নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার অনুরোধে কাজটি করেছিলাম। বলতে গেলে বিনা পারিশ্রমিকেই কাজটি করেছি। ক্লাসের পড়াশোনা গোল্লায় তুলে কাজটি করতে দারুণ লেগেছিল। কারণ অনেক বই পড়া হয়েছিল কাজটি করার সুবাদে। সুকুমারী ভট্টাচার্যের বৈদিক ভারতে নারীর অবস্থানবিষয়ক অবিস্মরণীয় রচনাবলি থেকে শুরু করে মণিকুন্তলা সেন, মালেকা বেগমসহ আমাদের উপমহাদেশের অনেক প্রখ্যাত নারীনেত্রীর ঋদ্ধ সব রচনা সংগ্রহ পড়া হয়েছিল। এ বইটির কোনো কপিই বর্তমানে আর অবশিষ্ট নেই। তবে ২০১০-এ অন্বেষা প্রকাশনী বইটি বাংলার নারী আন্দোলনের ইতিহাস নামে পুনরায় প্রকাশ করে। নতুন কলেবর, প্রচ্ছদ ও শিরোনামে প্রকাশিত এই বইয়ে কিছু নতুন তথ্যও যোগ করা হয়। স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট একটি প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করেছিল ’৯৮-এর মে মাসে। বহু খ্যাতনামা মানুষ এসেছিলেন, যাঁদের সঙ্গে একই মঞ্চে বসেছি। অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে সেই ছাত্রজীবনে একই মঞ্চে বসার আনন্দ আজও ভুলতে পারি না। এটি ছিল আমার প্রকাশিত প্রথম বই।তবে এটি মননশীল। আমার প্রথম সৃজনশীল বই ইমানুয়েলের গৃহপ্রবেশ স্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে ১৯৯৯ বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল। বইটি যেদিন স্টলে আসে, সেদিন মনে হচ্ছিল আমি এই পৃথিবীর রাজকন্যাদের একজন। মননশীল গ্রন্থে তেমন সাড়া থাকে না। কিন্তু ইমানুয়েলের গৃহপ্রবেশ ১০০ কপির ওপর মেলায় বিক্রি হয়েছিল। মাত্র মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে, ফলাফল না বেরোনো বেকার এক তরুণ লেখক রোজ বিকেলে মহা আনন্দে গিয়ে স্টলে বসছি। সবকিছু কী ভালো লাগে! মেলার ধুলা, এক কপি বই বিক্রি হওয়ার হূৎপিণ্ড ধুকপুুক, বন্ধুদের সঙ্গে ধুলাবসা ফুচকা খাওয়া...সবকিছুই আজও অম্লান স্মৃতি!
গ্রন্থনা: তৌহিদা শিরোপা

No comments

Powered by Blogger.