বিএসএফের মানবাধিকার লঙ্ঘন-বালাকৃষ্ণানের অভিমত আমলে নিন

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ও ভারত পরস্পর বন্ধু রাষ্ট্র হলেও নানা কারণে সদ্ভাব স্থায়ী রূপ ধারণ করতে পারছে না। কারণগুলোর অন্যতম সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও গোলাগুলি। অতীতের নানা টানাপড়েন সত্ত্বেও এখন দু'দেশের সরকার সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে আন্তরিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছে।


শুধু বন্ধুত্বই নয়, সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একটি সুদূরপ্রসারী উন্নয়ন-সম্পর্ক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও মূর্ত হয়ে উঠেছে। দু'দেশের সাধারণ মানুষ সরকারের এ মনোভাবকে স্বাগত জানিয়েছে, সম্পর্কের অগ্রযাত্রায় সমর্থন ব্যক্ত করেছে। দু'দেশের সম্পর্কের মধ্যে যখন সুবাতাস বইছে তখন হঠাৎ হঠাৎ বন্দুকের শব্দ এ সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সাধারণের মধ্যে অবিশ্বাস, সন্দেহ ও ভীতি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সবাই জানেন, দীর্ঘ সীমান্ত থাকার সুবাদে দু'দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য যেমন প্রচলিত তেমনি অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যও আছে। অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য-সম্পর্ককে কেন্দ্র করে দু'দেশের নাগরিকদের মধ্যে অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে, এ-ও জানা কথা। শুধু বাণিজ্যই নয়, দু'দেশের মানুষের ঐতিহাসিক সম্পর্কের কারণেও পরস্পরের ভূমিতে প্রবেশ ও অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। পৃথিবীর বহু দেশে এ ধরনের সম্পর্ক স্বাভাবিক বলেই গণ্য হয়। কোনো কোনো দেশ সীমান্তে কঠোরতা অবলম্বন করে, কিন্তু সীমান্তরক্ষীরা নিয়মিতভাবেই বন্দুক উঁচিয়ে এমন ঘটনা প্রতিরোধ করে, এমন উদাহরণ বোধহয় আর কোনো দেশের সীমান্তে নেই। বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা যে আচরণ করে, তা অনেক ক্ষেত্রেই নির্মম, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সীমান্তে কোনো এক দেশের নাগরিকরা যদি অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটান তবে বন্দুকের গুলিই একমাত্র সমাধান নয়। প্রয়োজনে গ্রেফতার করা যেতে পারে, আইন অনুসারে বিহিতও করা যেতে পারে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষগুলো কথা দিয়েছিল প্রাণঘাতী বুলেটের বদলে তারা রাবার বুলেট ব্যবহার করবেন। সেটিও পরিস্থিতিকে উপশম দিতে পারত। কিন্তু বিএসএফ যেভাবে সীমান্তে একের পর এক হত্যা-নির্যাতন-অপহরণের মতো ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে, তাতে উপশমের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে আরও গুলি চলবে, বিএসএফ কর্তৃপক্ষের এমন উক্তিও সাধারণ নাগরিকদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। বাংলাদেশে তাদের আচরণের তীব্র প্রতিবাদ হচ্ছে। আশার কথা, ভারতেও বিএসএফের আচরণের বিরুদ্ধে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। সীমান্তে এক বাংলাদেশিকে বিএসএফ যে নির্মম নির্যাতন করেছিল তা প্রথম ভারতীয় টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েই বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এমনকি সীমান্তে আরও গুলি চলবে এমন ঘোষণা দিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন বিএসএফপ্রধান। এবার ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি ও মানবাধিকার কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান বিএসএফের মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে মুখ খুললেন। কেজি বালাকৃষ্ণান বিএসএফকে সতর্ক করেছেন। গণতান্ত্রিক ভারতের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ সোচ্চার হলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিএসএফের অন্যায় আচরণ বন্ধ হবে_ এটি আশা করা যায়। তবে বিএসএফ যাতে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের কথা আমলে নেয়, সে জন্য সে দেশের সরকারকে তৎপর হতে হবে। বিএসএফ সদস্যদের মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে সজাগ করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হতো যদি দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের গুরুত্ব বিএসএফ সদস্য ও তাদের পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষকে বোঝানো যেত। আমরা মনে করি, বন্ধুত্ব, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ক কথাবার্তা অব্যাহত থাকলে বিএসএফের বৈরী মনোভাবের পরিবর্তন ঘটবে। পাশাপাশি, বিষয়টির স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের বিকল্প ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য দু'দেশকেই এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.