যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-শুরুতে হতাশা, শেষদিকে সাফল্য by এম বদিউজ্জামান

বিজয়ের ৪০ বছর পূর্ণ হয়েছে ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বিজয় দিবসের উৎসব থেকে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবি উঠেছে জোরেশোরেই। বিশেষ করে মহাজোট সরকারের শরিক দলগুলো মিছিল-মিটিং করেছে। অপরদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষভাবে বিচারের দাবি জানিয়ে বলছে, এ বিচারের জন্য যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের শুধু রাজনৈতিক কারণে হয়রানি করা হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীও একই


কথা বলছে। মহাজোট সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য অঙ্গীকার করে। আর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পর একই বছরের ১৪ জুলাই আইন সংশোধনের প্রায় এক বছর পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ওই বছরটি জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ পাঁচ নেতা দলটির আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এমপিকে (সাকা চৌধুরী) ও গত বছর বিএনপির আরেক নেতা আবদুল আলীমকে গ্রেপ্তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে সরকারের সাফল্য।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য সরকারের অঙ্গীকারের সাফল্য আসে ২০১১ সালের শেষ দিকে। জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, বর্তমান আমির নিজামীসহ জামায়াতের ছয় নেতা এবং বিএনপির দুই নেতার (সাকা চৌধুরী ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীম) বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্ত সংস্থা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করতে সক্ষম হয়।
এ সাফল্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাঈদীর বিচার শুরু করা। মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে ধীরগতির কারণে ট্রাইব্যুনাল বারবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন
২০০৯ সালের ১৪ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩ সংশোধন করে সরকার। এ আইনের ৩ ধারা সংশোধন করে ৩(১) যুক্ত করে তাতে ব্যক্তি বা ব্যক্তি বিশেষের বিচার করার এখতিয়ার দেওয়া হয়। জাতীয় সংসদ ২০০৯ সালের ৯ জুলাই সংশোধনী পাস করলেও রাষ্ট্রপতি একই বছরের ১৪ জুলাই অনুমোদনের পর তা আইনে পরিণত হয়। এ আইনের অধীন বিচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০১০ সালের ২১ জুলাই 'আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কার্যপ্রণালি বিধিমালা-২০১০' নামে বিধিমালা করা হয়। একই বছরের ২৮ অক্টোবর এবং ২০১১ সালের ২৯ জুন এ বিধিমালা দুদফা সংশোধন করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন জে র‌্যাপ গত বছরের ৩ মে বাংলাদেশে আসেন। এরপর আরো কয়েকবার তিনি বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় তিনি সরকার, ট্রাইব্যুনালের বিচারক, প্রসিকিউটর, তদন্ত সংস্থা এবং অভিযুক্তদের আইনজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
ট্রাইব্যুনাল গঠন
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ হাইকোর্টের বিচারপতি নিজামুল হক, বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এ কে এম জহির আহম্মেদকে নিয়ে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। একই সঙ্গে একটি তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন ইউনিট গঠন করে। অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব আবদুল মতিনকে প্রধান করে তদন্ত সংস্থা গঠনের পর প্রশ্ন ওঠে। শেষ পর্যন্ত তদন্ত সংস্থার প্রধান আবদুল মতিনকে তদন্ত সংস্থা থেকে সরিয়ে দেয় সরকার।
হাইকোর্টের একাধিক রিট আবেদন
ট্রাইব্যুনালে হাইকোর্টের দুজন বিচারক নিয়োগ দেওয়ার বৈধতা, সংশোধিত ট্রাইব্যুনাল আইনের সাতটি ধারা এবং জামায়াতের শীর্ষ চার নেতার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে পৃথক দুটি রিট আবেদন করা হলেও আদালত তা খারিজ করে দেন।
এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার প্রয়াত উইং কমান্ডার (অব.) হামিদুল্লাহ খান পৃথক একটি রিট আবেদন করেন। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের সম্মুখীন করা এবং তাদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে করা চুক্তির বাতিল চেয়ে এ রিট আবেদন করেন। হাইকোর্ট এ রিট আবেদনটিও খারিজ করেন।
বিচারপতি নাজমুল হককে প্রত্যাহারের আবেদন খারিজ
বিচারপতি নিজামুল হক ১৯৯৪ সালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কর্তৃক গঠিত গণতদন্ত কমিশন সচিবালয়ের সদস্য ছিলেন এ কথা বলে তাঁকে ট্রাইব্যুনাল থেকে প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে সাঈদী গত ২৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন। প্রথমে বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির ও এ এইচ এম জহির আহমেদ শুনানি গ্রহণ করে আবেদনটি নিষ্পত্তি করেন। কিন্তু সাঈদীর আইনজীবীরা বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আবার বিচারপতি নিজামুল হকের কাছেই আবেদন করেন। বিচারপতি নিজামুল হক সে আবেদনের ওপর শুনানি শেষে ২৮ নভেম্বর খারিজ করে দেন।
বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ
জামায়াত নেতাদের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার জন্য তিন ব্রিটিশ আইনজীবী স্টিফেন কে কিউসি, জন ক্যানেগ ও টবি ক্যাডম্যানকে আইনজীবী নিয়োগের অনুমতি চেয়ে গত বছর ১৭ জুলাই আবেদন করা হয়। ২৩ জুলাই বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ আবেদন নাকচ করে দেন। পরে বিএনপির সাকা চৌধুরী তাঁর পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন। গত ১৯ ডিসেম্বর বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের আবেদন খারিজ করে বলা হয়, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অনুমতি দিলে ট্রাইব্যুনালে বিদেশি আইনজীবী শুনানি করতে পারবেন।
সাঈদীর বিচার
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার চলছে। তাঁর বিরুদ্ধে গত বছর ৩১ মে চার হাজার ৭৪ পৃষ্ঠার ১৫ খণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। ১১ জুলাই ফরমাল চার্জ দাখিল করা হলে ট্রাইব্যুনাল ১৪ জুলাই ফরমাল চার্জ বিচারের জন্য আমলে নেন। ৩ অক্টোবর সাঈদীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, ধর্ষণ, হত্যা, লুটপাট, অগি্নসংযোগসহ ২০টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়। গত ৭ ডিসেম্বর সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। সাঈদীর বিচারের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের দীর্ঘ ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তির এই প্রথম বিচার শুরু হয়।
গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদ-কামারুজ্জামান
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম। তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগি্নসংযোগ, এক কোটি মানুষকে দেশান্তরিত করা, হিন্দু সম্প্রদায়কে ধর্মান্তরিত করাসহ মানবতাবিরোধী ৫২টি ঘটনায় শতাধিক অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ১২ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ১০০ পৃষ্ঠার ফরমাল চার্জের সঙ্গে ৩০ খণ্ডে কয়েক শ ডকুমেন্ট দাখিল করা হয়। এ ছাড়া নিজামী, মুজাহিদ ও কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ১১ ডিসেম্বর এবং কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৮ ডিসেম্বর ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়।
কিন্তু গোলাম আযম, মুজাহিদ ও কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ সুবিন্যস্ত না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তা রাষ্ট্রপক্ষকে ফেরত দিয়েছেন। গোলাম আযমের ক্ষেত্রে ৫ জানুয়ারি, মুজাহিদের ক্ষেত্রে ১২ জানুয়ারি এবং কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে ১৬ জানুয়ারি নতুন করে দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন। নিজামীর বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ পর্যবেক্ষণ শেষ না হওয়ায় আগামী ৯ জানুয়ারি নিজামীর বিষয়ে আদেশের জন্য দিন ধার্য রাখা হয়েছে।
সাকা চৌধুরী
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৯ জুনের মধ্যে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হলেও ৪ অক্টোবর ১১৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ১৪ নভেম্বর ফরমাল চার্জ জমা দেয়। ৫৫ পৃষ্ঠার ফরমাল চার্জের সঙ্গে এক হাজার ২৭৫ পৃষ্ঠার আনুষঙ্গিক নথিপত্র এবং ১৮টি সিডি জমা দেওয়া হয়। ১৭ নভেম্বর চেম্বারে বসেই সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। এ নিয়ে সাকা চৌধুরী ট্রাইব্যুনালে প্রশ্ন তোলেন। তাঁর বিরুদ্ধে আগামী ১৫ জানুয়ারি অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। এদিকে ট্রাইব্যুনালে তাঁকে নেওয়ার পর তিনি আইনজীবী নিয়োগ দিলেও পরে আইনজীবীদের প্রত্যাহার করে নেন। এ অবস্থায় ট্রাইব্যুনাল গত ১২ ডিসেম্বর তাঁর পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে সেস্ট ডিফেন্স আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে।
আবদুল আলীম
একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক মন্ত্রী বিএনপি নেতা আবদুল আলীমকে আটকের নির্দেশনা চেয়ে ২৩ মার্চ তদন্ত সংস্থা আবেদন করে। ২৭ মার্চ ট্রাইব্যুনাল আবদুুল আলীমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করায় পুলিশ ওই দিন রাতে জয়পুরহাট নিজ বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং ২৮ মার্চ সকালে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে। ট্রাইব্যুনাল তাঁকে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখার নির্দেশ দেন। এরপর ৩১ মার্চ তাঁকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার পর শর্তসাপেক্ষে তাঁর জামিন দেন ট্রাইব্যুনাল। তবে তাঁকে নিয়মিতভাবে ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দিতে হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ২১ জুলাইয়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে তদন্ত সংস্থাকে নির্দেশ দিলেও এখন পর্যন্ত তদন্ত শেষ করতে পারেনি।
আরো একটি ট্রাইব্যুনাল
গত তিন বছরে সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ না হওয়া এবং একটি ট্রাইব্যুনাল দিয়ে বিচারকাজে ধীরগতির কারণে সরকার আরো একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ জন্য আইন কমিশনকে পুরাতন হাইকোর্ট ভবন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেখানে নতুন ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষ, আসামি ও সাক্ষীর কাঠগড়া বানানোসহ অবকাঠামো তৈরির কাজ চলছে।

No comments

Powered by Blogger.