তিনি আগামী দিনকে সুন্দর করতে চেয়েছেন by মামুন রশীদ

স্যামসন এইচ চৌধুরী বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। যে কোনো মানদণ্ডেই প্রায় সবার কাছে তিনি মোর দ্যান হিজ লাইফ, অফুরান প্রেরণা। মহৎপ্রাণ মানুষটির দৃষ্টি ছিল সর্বদা সম্মুখপানে। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও ছিলেন স্কয়ার গ্রুপে প্রায় সব বিষয়ের কাণ্ডারি। পড়াশোনা শেষ করে নিজের গ্রামে ছোট ওষুধের দোকান দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে আরও তিন বন্ধুকে নিয়ে স্থাপন করেন স্কয়ার ওষুধ কোম্পানি। এখন এ প্রতিষ্ঠানটি


বাংলাদেশের অন্যতম বহুমুখী শিল্পগোষ্ঠী, বছরে টার্নওভার ৭৩ কোটি ডলার। ওষুধ, বস্ত্র, তৈরি পোশাক, টয়লেট্রিস, মসলা, ইলেকট্রনিক সামগ্রী_ কত মানসম্পন্ন পণ্যই না তারা জোগান দেয়। ১৯৯২ সালে গ্রিনলেজ ব্যাংকে কাজ করার সময় তার সঙ্গে পরিচয়। তার সম্প্রসারিত হয়ে চলা ব্যবসার একটি অংশ ব্যাংকের জন্য পাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে কয়েকবার দেখা করি। জনতা ব্যাংকের সঙ্গে তার বিভিন্ন কোম্পানির লেনদেন ভালোই চলছিল। কিন্তু আমরা ভরসা ছাড়িনি। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৫ সালে স্কয়ার ফার্মাকে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক (গ্রিন্ডলেস ব্যাংক ততদিনে এ ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়েছে) ক্লায়েন্ট করতে সক্ষম হয়। চোখের সামনেই স্কয়ার বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে। ব্যবস্থাপনাও হয়ে উঠতে থাকে একই মানের। সহকর্মীরা তাকে মনে করতে থাকেন অভিভাবকতুল্য। তার ব্যক্তিগত আচরণ এবং রসবোধ সবাইকে মুগ্ধ করত। আইসিসি বাংলাদেশ সভাপতি মাহবুবুর রহমান, ট্রান্সকমের স্বত্বাধিকারী লতিফুর রহমান, নিউ এজ গ্রুপের এমএ কাসেম, অ্যাপেক্স গ্রুপের সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী প্রমুখ তার উদ্যোগ, ধীরস্থির ব্যবস্থাপনা কৌশল, সবকিছুর পরও হাসিখুশি থাকা_ এসব বিষয়ে আরও ভালো বলতে পারবেন। তিনি যেভাবে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে মানিয়ে চলতেন, সেটা যে কোনো বিজনেস স্কুলে আগামী অনেক দিন পাঠ্য বিষয় হিসেবে থাকবে।
মান, মান এবং মান_ ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি কোয়ালিটি_ সেটাই ছিল তার মন্ত্র। তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন, সাফল্যের সহজ-সরল পথ নেই। প্রতিটি পয়সা উপার্জন করতে হবে শ্রম ও সাধনায়। এটাই তাকে দেশের অন্যতম শীর্ষ করদাতায় পরিণত করেছে। তার কাজের ধরন, নিরলস প্রচেষ্টা এবং উচ্চ নৈতিকতা তাকে অনেকের জন্যই রোল মডেলে পরিণত করেছে। ২০১০ সালের এপ্রিলে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেসে 'ইথিকস ইন অন্ট্রপনারশিপ' বিষয়ে বক্তব্য রাখতে এসেছিলেন তিনি। এ আলোচনা মডারেট করার সুযোগ আমার ঘটেছিল। ছাত্রছাত্রীরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে আলোচনা শোনে। মূল আলোচনার পর আসতে থাকে একের পর এক প্রশ্ন এবং ৮৪ বছর বয়সেও তিনি দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেন। সে সময়ে তাকে সত্যিই মনে হয়েছিল বাংলাদেশের কনিষ্ঠতম শিল্প ও ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা। শুরুর দিকের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে...। তিনি কখনও আশা ছাড়েননি, প্রতিকূলতায় ভয় পাননি। বাধা জয় করার জন্য যা কিছু করার ধৈর্য ধরে করে গেছেন। নতুন নতুন ক্ষেত্রে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে গিয়ে ঘুরে-ফিরে এসেছে একই সমস্যা। তিনি হাল ছাড়েননি। ব্যবসায়িক ব্যয় কমিয়ে আনার জন্য জার্মানির ডিইজি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ধার করায় তার নিরলস চেষ্টা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারেন। উদ্যোগী মনোভাব, নিরলস সাধনা ও উচ্চমানের প্রতি অঙ্গীকার তাকে বিপুল স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। ১৯৯৮ সালে আমেরিকান চেম্বার, বাংলাদেশ তাকে বিজনেস এক্সিকিউটিভ অব দি ইয়ার মনোনীত করে। ডেইলি স্টার এবং ডিএইচএল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড এক্সপ্রেস ২০০০-২০০১ সালে তাকে বেস্ট অন্ট্রপনার অব দি কান্ট্রি স্বীকৃতি দেয়। তিনি মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি এবং টিআইবির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। স্যামসন চৌধুরী আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু অন্ট্রপনারশিপের ক্ষেত্রে সর্বদা সেরাটা খুঁজে পাওয়ার নিরলস চেষ্টা তাকে সর্বদা স্মরণে রাখবে। তিনি আগামী দিনকে ভালো করতে চেয়েছেন এবং এ ক্ষেত্রে 'আমার যা সাধ্য তা করিব আমি' মনোভাবে ছিলেন অবিচল। তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।

মামুন রশীদ :ব্যাংকার ও
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
mamun1960@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.