কালের পুরাণ-কুমিল্লা কী বার্তা দিল সরকারকে? by সোহরাব হাসান

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জন করেছিল বিরোধী দল বিএনপি ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) চালুর প্রতিবাদে। বিএনপির নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সমর্থক পণ্ডিত-বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত ইভিএমের বিরুদ্ধে গাদা গাদা তথ্য-যুক্তি হাজির করেছিলেন। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ইভিএম পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে। এখন বাংলাদেশে এই পদ্ধতি নাকি চালু করা হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় বসানোর জন্য। এ পর্যন্ত যে তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে


ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা—কোনোটিতেই আওয়ামী লীগ-সমর্থক প্রার্থী জিততে পারেননি। কুমিল্লায় পুরো ভোট হয়েছে ইভিএম পদ্ধতিতে। মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় ফল। মহাবিশেষজ্ঞরা কী বলবেন এখন?
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জয়ী হয়েছেন মনিরুল হক। বিএনপি তাঁকে ত্যাগ করলেও ভোটাররা ত্যাগ করেননি। বিজয়ী মনিরুলকে অভিনন্দন। তিনিও স্বীকার করেছেন ইভিএম নিয়ে তাঁর মনে ভীতি ছিল। আসলে এই ভীতিটা মেশিনের নয়, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির। রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতা-কর্মীরা ঠিক থাকলে ইভিএম বা নির্বাচন কমিশন কোনো সমস্যা নয়। এই সত্যটি মনিরুল হক নির্বাচনে জয়ী হয়ে বুঝতে পারলেও তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া বিএনপির জাঁদরেল নেতারা বুঝতে পারেননি। এত দিন তাঁদের কাছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নাজায়েজ হলেও এখন জায়েজ হয়ে যাবে। দলীয় নেত্রী অব্যাহতি দেওয়া মনিরুল হককে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেও নেবেন। এই হলো আমাদের স্ববিরোধী রাজনীতি।
একই সঙ্গে অভিনন্দন জানাই কুমিল্লার ভোটারদের। তাঁরা নির্ভয়ে পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরেছেন। অভিনন্দন জানাই নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিটি কর্মকর্তা ও কর্মীকে, যাঁরা ভোটারদের আমানত রক্ষা করতে পেরেছেন।
বিএনপির যে নেতারা এত দিন নির্বাচন কমিশন ও ইভিএমের কঠোর সমালোচনা করেছেন, তাঁদের উচিত নির্বাচন কমিশন ্ও ইভিএম এর কাছে ক্ষমা চাওয়া। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বর্তমান নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনায় যে বুদ্ধিমত্তা, সাহস ও কৌশলের পরিচয় দিয়েছে, তার জন্য সাধুবাদ প্রাপ্য। আমরা যদি ভালো কাজের প্রশংসা করতে না পারি, তাহলে সমাজে ও রাষ্ট্রে খারাপ দৃষ্টান্তই বেশি স্থাপিত হবে।

২.
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহ্লাদিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগই ফার্স্ট ও সেকেন্ড।’ এর মাধ্যমে তিনি বিজয়ী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী শামীম ওসমানকে বুঝিয়েছিলেন। বিএনপির সমর্থক প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার দলের নির্দেশে শেষ মুহূর্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার পর তাঁর বাক্সে যে ভোট পড়েছিল, সেটি জনপ্রিয়তার মাপকাঠি হতে পারে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেই ভোটকেই জনপ্রিয়তার মাপকাঠি ধরেছিলেন।
এবার তিনি কী বলবেন? কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ফার্স্ট, সেকেন্ড ও থার্ড প্রার্থী মিলেও বিএনপির দলত্যাগী প্রার্থীর কাছাকাছি ভোট পাননি। মনিরুল হক পেয়েছেন ৬৫ হাজার ৫৭৭ ভোট এবং আওয়ামী লীগের ফার্স্ট প্রার্থী (আফজল খান) পেয়েছেন ৩৬ হাজার ৪৭১ ভোট, সেকেন্ড প্রার্থী (নূর-উর রহমান মাহমুদ) আট হাজার ৫১৪, থার্ড প্রার্থী (আনিসুর রহমান) তিন হাজার ৯৯৪।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভোট গ্রহণের সময় কেন্দ্রে মনিরুল হকের ব্যাজ পরা লোক তেমন দেখা যায়নি। অধিকাংশই আফজল খানের ব্যাজ পরেছিলেন। কিন্তু ফলাফল সম্পূর্ণ উল্টো। অর্থাৎ ভোটাররা বুকে যাঁর ব্যাজই পরুন না কেন, মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন কাকে ভোট দেবেন।
নারায়ণগঞ্জে যেমন শামীম উসমানকে সমর্থন দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছিল, তেমনি কুমিল্লায় আফজল খানের সমর্থনের বেলায়ও। দুই ক্ষেত্রেই ওপর থেকে প্রার্থী চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামত নেওয়া হয়নি। সাধারণ ভোটার তো দূরের কথা, স্থানীয় আওয়ামী লীগের সিংহভাগ নেতা-কর্মীই তাঁদের প্রার্থী হিসেবে মানতে পারেননি, যার প্রতিফলন ঘটেছে ফলাফলে।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী আফজল খানের পক্ষে দলের বড় বড় নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সাংসদেরা লাগাতার প্রচার চালিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সেই প্রচারণা ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেছে। অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়ায় দলের কোনো কেন্দ্রীয় বা জেলা পর্যায়ের নেতাকেও মনিরুল হক কাছে পাননি। তাঁকে লড়তে হয়েছে একা। তাঁর ভরসা ছিল সাধারণ ভোটার, আরও নির্দিষ্ট করে বললে নতুন প্রজন্মের ভোটার।
এর মাধ্যমে কী বার্তা পেল সরকার ও ক্ষমতাসীন দলটি? মানুষ আর নিন্দিত ও বিতর্কিত কোনো ব্যক্তিকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চায় না। মানুষ গডফাদার ও দুর্নীতিবাজ চায় না। সৎ ও যোগ্য প্রার্থী চায়। দলের চেয়ে প্রার্থীর যোগ্যতাকে তারা বেশি মূল্য দেয়।
আমরা নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লার নির্বাচনী ফল বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাব সেখানে বিতর্কিত প্রার্থীদের জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। কুমিল্লায় কেবল মেয়র পদেই আওয়ামী লীগবিরোধী প্রার্থী জেতেননি, অধিকাংশ কাউন্সিলর পদেও তাঁরা জয়ী হয়েছেন। সাধারণ ২৭টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদের মধ্যে বিএনপি জিতেছে ১৩টি আর আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হয়েছেন মাত্র পাঁচজন।
অবশ্য আওয়ামী লীগের বিজ্ঞ নেতা-নেত্রীরা বলতে পারেন, এটি স্থানীয় সংস্থার নির্বাচন। এতে দলের জনপ্রিয়তা যাচাই হয় না। তাহলে কিসে যাচাই হয়? তাঁরা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় কতটা ধস নেমেছে? গতকাল প্রথম আলোয় প্রকাশিত ওআরজি কোয়েস্টের জরিপে দেখা যায়, ২০০৯ সালে যেখানে ৫৬ শতাংশ লোক আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছিল, ২০১১ সালে সেখানে সমর্থন করছে মাত্র ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে ২০০৯ সালে বিএনপির পক্ষে ছিল মাত্র ২৫ শতাংশ মানুষ, ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশ।
নির্বাচন হতে আরও দুই বছর বাকি। সরকারের কাছে নিশ্চয়ই আলাদিনের চেরাগ নেই যে তারা রাতারাতি দেশের চেহারা পাল্টে দেবেন। সব সমস্যার সমাধান করবেন।
আওয়ামী লীগের নেতাদের মনে রাখতে হবে, জনপ্রিয়তা কোনো দল বা ব্যক্তির কবলা করা সম্পত্তি নয় যে একবার মালিকানা পেয়ে গেলে আর হাতছাড়া হবে না। অতএব সাধু সাবধান।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.