কালের আয়নায়-একে একে তিনটি দুর্গের পতন :তারপর? by আবদুল গাফফার চৌধুরী

কুমিল্লা নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত ছিল, আগের দুই সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচনে তাদের বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানের জন্য একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন এবং সেই কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ ও সঠিক প্রার্থীকে সমর্থন দান। তা না করে তারা ঢাকা সিটি করপোরেশনে পরাজয় ঠেকানোর জন্য এই করপোরেশনকে দু'ভাগ করার চেষ্টায় ও বিতর্কে সময় নষ্ট করেছেন এবং কুমিল্লা সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচনেও


একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করেছেন গত বৃহস্পতিবার অর্থাৎ দু'দিন আগে লন্ডনে বসবাসকারী আওয়ামী লীগের এক শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু আমাকে যখন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আফজল খানের শোচনীয় পরাজয়ের খবর দিলেন, তখন আমি বিস্মিত হইনি। এমন একটি খবর পাব সেই আশঙ্কা করছিলাম। আশঙ্কাটি সত্যে পরিণত হলো মাত্র। বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, কুমিল্লার মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এই দারুণ পরাজয়ে আপনি কি বিস্মিত হয়েছেন?
তিনি বললেন, 'না বিস্মিত হইনি। এই পরাজয় আওয়ামী লীগের প্রাপ্য পরাজয়। খবরটা শোনা অবধি এক ধরনের দার্শনিক-উদাসীনতা বোধ করছি। কৈশোরে পড়া রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার অংশবিশেষ স্মরণ থেকে আবৃত্তি করছি।' বললাম, কবিতাটি টেলিফোনেই আমাকে শোনান। তিনি আবৃত্তি করলেন :
'গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা
কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা।'
বলেছি, আর পড়তে হবে না। বাংলাদেশের গগনে মেঘের ঘনঘটা। আমরা দু'জনে বহুদূরের টেমস নদীর কূলে বসে আছি। মনে কোনো ভরসা পাচ্ছি না।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচনে আফজল খান যে পরাজিত হবেন এবং নাগরিক কমিটি দ্বারা সমর্থিত প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু যে বিরাট ভোটে জয়ী হবেন এই আভাস কুমিল্লা থেকে বহু আগে আওয়ামী লীগ সমর্থক বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকেই জেনেছিলাম। তারা বলেছিলেন, 'দুই কারণে আফজল খান পরাজিত হবেন। প্রথমত. ভোটদাতাদের কাছে তার কোনো গুড ইমেজ বা ভালো ভাবমূর্তি নেই। সত্য হোক আর মিথ্যা হোক, তার সম্পর্কে নানা দুর্নাম। সন্ত্রাস থেকে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল ইত্যাদি নানা অভিযোগ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো নয়। কুমিল্লায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলও আফজল খানের পরাজয়ের কারণ হবে।'
আমি আফজল খানকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সুযোগ কখনও আমার হয়নি। তবে কুমিল্লার মেয়র প্রার্থী হওয়ার পর ঢাকার কাগজে তার ছবি দেখেছি। টুপি-দাড়ি শোভিত সজ্জন চেহারা। তার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ কেন? কুমিল্লার এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছি। তিনি উল্টো প্রশ্ন করেছেন, "টুপি-দাড়ি শোভিত 'নূরানি' চেহারা তো জামায়াতের শীর্ষ নেতাদেরও। তাদের সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?" আমি আর কথা বাড়াইনি।
এখন প্রশ্ন হলো, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচনের ঘটনা থেকে আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন শিক্ষা নিলেন না? ভুল শোধরালেন না? কুমিল্লায় কি একজন ভালো এবং জনগণের পছন্দসই প্রার্থী পাওয়া গেল না, যাকে সমর্থন দিয়ে জিতিয়ে আনা যেত? চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং কুমিল্লা এই তিনটি দুর্গের পতনের পর এখন কেন্দ্রীয় দুর্গ ঢাকার দিকে সকলের চোখ। অনেকের ধারণা, এখানেও সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচনে পরাজয়ের ভয়ে আওয়ামী লীগ সরকার করপোরেশনকে দু'ভাগ করেছে। সঠিক হোক আর বেঠিক হোক এই ধারণাটা অধিকাংশ মানুষের মনে গেঁথে গেছে। অনেক আওয়ামী লীগারের মনেও ভয় ঢুকে গেছে, ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করেও আওয়ামী লীগ সমর্থিত দু'জন মেয়র প্রার্থীর একজনকেও জয়ী করা যাবে কিনা?
আমাদের একান্ত প্রার্থনা, ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুই মেয়র পদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেন একটিতেও পরাজিত না হয়। কিন্তু আমাদের প্রার্থনা যদি কবুল না হয় এবং আওয়ামী লীগ ঢাকার দুটি মেয়র পদই হারায়, তাহলে একটি গুরুতর প্রশ্ন উঠবে, আওয়ামী লীগ চার-পাঁচটি বড় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর দেশ শাসনের অধিকার রাখে কিনা? যদি এই নির্বাচনগুলোর গণরায়কে সরকারের প্রতি দেশের মানুষের অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ বলে গণ্য করে বিরোধী দল আগাম নির্বাচন দাবি করে, তাহলে তা খুব অসঙ্গত হবে কি? আওয়ামী লীগ সরকার হয়তো তারপরও সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখিয়ে ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ পূর্ণ করতে চাইবে। কিন্তু এভাবে দেশ শাসনে আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের মনেই কোনো নৈতিক শক্তি বোধ করবে কি?
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকার শেষ পর্যায়ে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে বিরাট পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। তখনই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন যে, পরবর্তী রাজ্যসভার নির্বাচনে বামফ্রন্ট পরাজিত হবে এবং ক্ষমতা হারাবে। বামফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা তা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাকে পাত্তা দেননি। তারপর রাজ্যসভার নির্বাচনে যখন বামফ্রন্ট শিকড়সহ উপড়ে পড়েছে, মুখ্যমন্ত্রীসহ একজন মন্ত্রীও নির্বাচিত হতে পারেননি, তখন তাদের হুঁশ হয়েছে। এখন তারা নির্বাচনে বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধান ও তার প্রতিকারের জন্য বড় বড় কমিটি গঠন করেছেন। এটা যে এখন ভস্মে ঘি ঢালা সে কথা বামফ্রন্টের অধিকাংশ নেতা বোঝেন না তা নয়।
বাংলাদেশে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচনে অভাবনীয় পরাজয়ের পরই আওয়ামী লীগের সতর্ক হয়ে পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান এবং তার প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচনে তো আওয়ামী লীগ রীতিমতো হারিকিরিনীতি গ্রহণ করেছিল। যদিও নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ দাবি করেছে, এটা তাদেরই বিজয়; কারণ আইভী আওয়ামী লীগেরই লোক এবং আওয়ামী লীগের প্রতি তিনি আনুগত্য অক্ষুণ্ন রেখেছেন। তথাপি এই হিসাব শুভঙ্করের ফাঁকির হিসাব। আসল হিসাব নয়।
কুমিল্লা নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত ছিল, আগের দুই সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচনে তাদের বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানের জন্য একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন এবং সেই কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ ও সঠিক প্রার্থীকে সমর্থন দান। তা না করে তারা ঢাকা সিটি করপোরেশনে পরাজয় ঠেকানোর জন্য এই করপোরেশনকে দু'ভাগ করার চেষ্টায় ও বিতর্কে সময় নষ্ট করেছেন এবং কুমিল্লা সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচনেও একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করেছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু নিজের মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে কংগ্রেসের সভানেত্রী পদে বসানোর পর যখন ভবিষ্যতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে বসানোর জন্যও পরিকল্পনা করেন, তখন মেয়েকে একটি উপদেশ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। উপদেশটি হলো, 'কখনো নিজের জেদ দ্বারা দেশ শাসনের চেষ্টা করো না। সেখানে প্রজ্ঞার পরিচয় দেবে। দেশ শাসনে নিজের পছন্দ-অপছন্দ নয়, জনগণের পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিও। তোমার চারপাশে যেন দুর্বৃত্ত ও চাটুকাররা ঘাঁটি গাড়তে না পারে।' ইন্দিরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই উপদেশ অনুসরণ করেছিলেন কি? তিনি তার চারপাশ থেকে নির্বিচারে পিতৃবন্ধুদের বিদায় করে চাটুকার ইয়েসম্যানদের এনে স্থান দিয়েছিলেন। পুত্র সঞ্জয় ও তার দুর্বৃত্ত পারিষদরা যুব কংগ্রেস ও কংগ্রেস দল প্রায় দখল করে ফেলেছিল। দেশ শাসনে প্রজ্ঞা নয়, ব্যক্তিগত জেদই হয়ে দাঁড়িয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ। পরিণতি, সত্তরের দশকের এক নির্বাচনে শুধু কংগ্রেসের ভরাডুবি নয়, ইন্দিরা গান্ধীরও ব্যক্তিগত পরাজয় এক অখ্যাত প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে।
ভারতের ইন্দিরা-কংগ্রেসের পরিণতি থেকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেছে কি? এখনও শিক্ষা গ্রহণ করার সময় আছে। এখনও সুযোগ আছে, ভুলত্রুটি সংশোধন করে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াতে পারে। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা এই তিনটি সিটি করপোরেশনেরই নির্বাচন ফল দেখে বিনা দ্বিধায় বলা চলে, দেশের মানুষের ভোটদানের প্যাটার্ন ও মানসিকতা বিরাটভাবে পাল্টে গেছে। তারা আর দলীয় ও নেতা-নেত্রীর ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভোটদানে রাজি নয়। তারা চায় না, কোনো দল তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অভিযুক্ত দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দিক অথবা জনপ্রতিনিধির আসনে বসানোর চেষ্টা চালাক। তারা দলের ছাপ না থাকলেও ভালো লোককে, পছন্দের লোককে ভোট দিতে শিখেছে। কুমিল্লার সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচনে ভোটদাতাদের কাছ থেকে পাওয়া এই রেড সিগন্যালও আওয়ামী লীগ উপেক্ষা করলে ভবিষ্যতে কী দাঁড়াবে তা শুধু ভবিতব্যই জানে।
আমার বন্ধু মোনায়েম সরকার বলেন, 'আওয়ামী লীগের উচিত পচা ডিমগুলো ঝুড়ি থেকে ফেলে দেওয়া।' বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, দলটির সাম্প্রতিককালের ইতিহাস হচ্ছে, এই ঝুড়ি থেকে নিজ থেকেই খসেপড়া পচা ডিমগুলো আবার ঝুড়িতে তুলে আনা এবং জনগণের কাঁধেও চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা। জনগণ তা মানছে না। তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আওয়ামী লীগ সরকার যদি ক্রমাগত দেয়ালের লেখা পড়তে ভুল করে, তাহলে আগামী সাধারণ নির্বাচনে দশ নম্বর বিপদসংকেতের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত তিন বছরের শাসন সম্পর্কে ঢাকার একটি দৈনিকের সমীক্ষার হেডিং হচ্ছে, 'ব্যর্থতার গ্রাসে সাফল্য'। গত তিন বছরের বাস্তবতার সঠিক প্রতিফলন ঘটেছে এই সমীক্ষার শিরোনামে। বর্তমান সরকারের দেশ শাসনে অনেক সাফল্য, কিন্তু সবই ব্যর্থতার গ্রাসে তলিয়ে যাচ্ছে রাজা ক্যানিউটের সভাসদদের দ্বারা দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে। দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ ও অযোগ্য ব্যক্তিদের দল এবং সরকার থেকে বিতাড়নে অক্ষমতার জন্য। আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জানা উচিত, আগামী নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগের বিপর্যয় ঘটে, তা হলে তা শুধু আওয়ামী লীগের একার জন্য বিপর্যয় হবে না, বিপর্যয় হবে স্বাধীনতা রক্ষাকামী, দেশপ্রেমিক এবং গণতন্ত্রমনা সব দেশবাসীর। গোটা দেশকে এই বিপর্যয়ের মুখে নিজেদের কর্মকাণ্ড দ্বারা ঠেলে দেওয়ার কোনো অধিকার আওয়ামী লীগের নেই।
আওয়ামী লীগ সরকারকে এত হুশিয়ার করার পরও তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েই একটি কারণে তাদের অভিনন্দন জানাব এবং তা হচ্ছে, শুধু সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনেই নয়, সব নির্বাচনে ও উপনির্বাচনেও কোনো কারচুপি হতে না দেওয়া। নির্বাচনগুলো মোটামুটি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ সরকার প্রমাণ করেছে যে, তাদের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। এরপরও যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের ধুয়া তুলে হৈচৈ করছেন, তারা যে 'মতলবের গোঁসাই' তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লন্ডন, ৬ জানুয়ারি ২০১২, শুক্রবার

No comments

Powered by Blogger.