মূল রচনা-কষ্টের নাম ‘বাঁধ’ by দুলাল ঘোষ

তিতাস নদীর বুকে মাটি ও বালুর বস্তা ফেলে তৈরি হয়েছে রাস্তা। এ রাস্তা দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুেকন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশবাহী ট্রেইলার চলাচল করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের ৩০ নভেম্বর ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুেকন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশ বা ওভার ডাইমেনশনাল কার্গোজ (ওডিসি) পরিবহনবিষয়ক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। এতে বাংলাদেশের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, ভারতের অয়েল


অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানি (ওএনজিসি) এবং ত্রিপুরা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (ওটিপিসি) সই করে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার পালাটানায় বিদ্যুত্ উত্পাদনকেন্দ্রের ৯৬টি কনটেইনার পশ্চিমবঙ্গ থেকে নৌপথে বাংলাদেশের আশুগঞ্জ নৌবন্দরে আসছে। সেখান থেকে সড়কপথে আখাউড়া স্থলবন্দর হয়ে ত্রিপুরায় যাচ্ছে। আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ৪৭ কিলোমিটার সড়কে চারটি সেতু ও ১৫টি কালভার্ট আছে। সেতুগুলো ৫০ থেকে ৬০ বছরের পুরোনো। এগুলো ১৫ টনের বেশি ভার বহনে অক্ষম। ভারতীয় কনটেইনারগুলোর সর্বোচ্চ ওজন ৩২৫ মেট্রিক টন। এ কারণে সেতু ও কালভার্টের পরিবর্তে নদী ও খালে বাঁধ দিয়ে বিকল্প সড়ক নির্মাণের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
সওজ সূত্রে আরও জানা গেছে, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার পর আসাম বেঙ্গল ক্যারিয়ার নামের ভারতীয় পরিবহন সংস্থা (এবিসি) আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত সেতুগুলোর পাশে খাল ও নদীতে বিকল্প সড়ক নির্মাণ শুরু করে। গেল বছরের ২৯ মার্চ বিকল্প এ রাস্তা ব্যবহার করে পালাটানা বিদ্যুেকন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশবাহী ট্রেইলার চলাচল শুরু হয়।
নদীর মাঝ দিয়ে তৈরি এই বিকল্প সড়কের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে তিতাসপারের বিভিন্ন এলাকায়। আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহনোয়াজ খান জানান, তিতাসে বাঁধ দেওয়ার ফলে গেল বর্ষায় পাহাড়ি ঢলে তিতাসসহ কয়েকটি সেতুর নিচের বিকল্প সড়ক ডুবে যায়। সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এর মধ্যে দক্ষিণ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম তলিয়ে গিয়ে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমির ক্ষতি হয়। এ ছাড়া তিতাসে বাঁধ দেওয়ায় নৌপথে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়।
এদিকে, নদীর বুক চিরে বিকল্প রাস্তা তৈরির আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। ব্রাক্ষণবাড়িয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. হাছান আলী প্রথম আলোকে বলেন, প্রকৃতি নিজের মতো চলবে। তাতে বাধা দিলে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তবে তিনি মনে করেন, রাস্তাগুলো দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে পরিবেশের বেশি ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমীর সভাপতি এবং সাহিত্যিক জয়দুল হোসেন বলছিলেন, ‘ষাটের দশকেও তিতাসের বুকে ১২ মাস লঞ্চ চলত। এখন এক মাসও চলে না। সময়মতো খনন না করায় পলি পড়ে নদী এমনিতেই ভরাট হয়ে যাচ্ছিল। নদীর বুকে বাঁধ দেওয়ায় যেটুকু জীবন ছিল সেটাও নিঃশেষ হয়ে গেছে।’
আখাউড়ার প্রবীণ শিক্ষক নায়েব আলী ভূঁইয়া। তিতাস নদী নিয়ে দীর্ঘদিন লেখালেখি করছেন। তাঁর মতে, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এর গতি রোধ করা হলে নদীটির গলাই টিপে ধরা হবে। এতে নদীর জলজ প্রাণ আর বৈচিত্র্য নষ্ট হবে। নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
ভারতীয় পরিবহন সংস্থা এবিসির বাংলাদেশি এজেন্ট গালফ ওরিয়েন্ট সি ওয়েজের প্রকৌশলী মো. ফারুক আহম্মেদ জানান, ভারী সব যন্ত্রাংশই ত্রিপুরায় চলে গেছে। এখন মাত্র ১৭টি মডিউল (যন্ত্রাংশ বহনকারী বৃহত্ আকারের কনটেইনার) রয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম বলছিলেন, চুক্তি ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত। সেতু ও কালভার্ট এলাকায় নদী-খালে বাঁধ দিয়ে যে বিকল্প সড়ক তৈরি করা হয়েছে, তা এ মাসের মধ্যেই কেটে দেওয়া হবে বলে এবিসি জানিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক আবদুল মান্নান জানান, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই বাঁধ কেটে নদীকে তাঁর স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.