পাট রফতানিতে ধস by আলতাব হোসেন

দু'বছর বিশ্ববাজারে পাটের রমরমা ব্যবসার পর এবার মন্দা শুরু হয়েছে। চলমান বিশ্বমন্দার ঢেউ আঘাত হেনেছে দেশের পাটশিল্পে। এরই মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে পাট রফতানি। হাটে পাটের ক্রেতা নেই। রফতানিকারকরা গুদামে ৩০ লাখ বেল পাট নিয়ে বসে আছেন। বিশ্ববাজারেও ক্রেতা নেই। দু'মাস ধরে দেশ-বিদেশে পাটের দাম অব্যাহতভাবে কমছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকটের কারণে কার্পেট ও পাটজাত শৌখিন পণ্যের বিক্রি


কমে গেছে। থাইল্যান্ডে বন্যার কারণে পাটের বিশ্ববাজারে মন্দা দেখা দিয়েছে। পাট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়ায় পাটজাত পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত ওই বাজার ধরার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গত বছর রেকর্ড পরিমাণ ২২ লাখ বেল পাট রফতানি হয়। চলতি বছর তা ১৫ লাখ টনে নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কাঁচা পাট ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা পাটের নতুন বাজার অনুসন্ধান, ব্যাংকের সুদের হার কমানো ও রফতানিকারকদের ভর্তুকি দেওয়াসহ নানা পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন। পাট শিল্পকে বাঁচাতে বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৪ দফা দাবি জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে দেশে ৬৫ লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়। গত বছরের ক্যারিওভার ১০ লাখ বেল নিয়ে এ বছর দেশে পাটের মজুদ ৭৫ লাখ বেল। মৌসুমের শুরুতে সরকারি পাটকলগুলো ১১৫টি পাট ক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে পাট খরিদ শুরু করে। এ সময় প্রতি মণ পাট ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা দরে বিক্রি হলেও বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে প্রকারভেদে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা মণ দরে।
পাট ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যমতে, কেবল খুলনার দৌলতপুরের বিভিন্ন পাট গুদামেই ২ লাখ ৭৫ হাজার টন কাঁচা পাট অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। অবিক্রীত এ পাটের মূল্য কমপক্ষে ১৬ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন কাঁচা পাটের দাম ছিল ৬৮৮ ডলার। নভেম্বর মাসে প্রতি টন কাঁচা পাট ৫৯৯ ডলারে বিক্রি হয়।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন এ পর্যন্ত মাত্র ৬ লাখ বেল পাট কিনেছে। বেসরকারি পাট রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো ১০ লাখ বেল পাট খরিদ করেছে বলে বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে। গত ৪ মাসে পাট রফতানিকারকরা মাত্র সাড়ে ৪ লাখ বেল পাট রফতানি করেছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রেজাউল করিম। তিনি জানান, বর্তমানে বেলার ও শিপারদের হাতে যে পরিমাণ পাট মজুদ আছে তা রফতানি না করা পর্যন্ত নতুনভাবে তাদের পক্ষে পাট ক্রয় করা সম্ভব নয়।
বিজেএমসির পরিচালক (পাট) তরিকুল ইসলাম জানান, বিজেএমসি তাদের মিলের চাহিদা অনুযায়ী পাট খরিদ করে থাকে। বর্তমানে সরকারি পাট ক্রয়কেন্দ্রগুলোর দেনার
পরিমাণ ১৫০ কোটি টাকা। মিলগুলোতে মজুদ আছে ১২০০ কোটি টাকার পাটপণ্য। তিনি জানান, সরকারিভাবে নতুন করে অর্থায়ন ও পাটপণ্য বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ না করা পর্যন্ত পাট খরিদ সম্ভব হবে না।
অভিযোগ রয়েছে, পাট মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পাট কল করপোরেশনের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আন্তর্জাতিক বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ। তিন বছর ধরে বিজেএমসি তাদের ২১টি পাটকলে উৎপাদিত সব পাটপণ্য শুধু ভারতে রফতানি করছে। ফলে চীন, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, সুদানসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশ থেকে পাট আমদানি করার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করছে। সরকার ইতিমধ্যে রফতানিকারকদের চাপে ভারতে কাঁচা পাটের বেল রফতানি বন্ধ ঘোষণা করলেও এর প্রভাব এখনও কাটেনি।
বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজমুল হক বলেন, ২০১০ সালে সরকার পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটপণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে আইন করেছিল। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এই আইন বাস্তবায়িত হলে দেশে উৎপাদিত পাটের ৬০ শতাংশ দেশীয় শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই আইন বাস্তবায়ন শুরুই হয়নি।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এ ব্যাপারে সমকালকে বলেন, লিবিয়া, ইরান ও তুরস্ক বাংলাদেশের পাটের বড় বাজার ছিল। মধ্যপ্রাচ্য সংকট, তুরস্কে ভূমিকম্প ও ডলারের দামের ওঠানামার কারণে বাংলাদেশের মূল আন্তর্জাতিক ক্রেতারা পাট কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। অচিরেই এ সংকট কেটে যাবে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.