নিয়তির কাঁধে জীবন সঁপে by সুমিত বণিক

কটি শিশুর আগমন একটি পরিবারের জন্য যেমন আনন্দের বার্তা বয়ে আনে, তেমনি ওই শিশুটিকে জন্ম দিতে গিয়ে একজন গর্ভবতী মহিলার গর্ভকালীন, প্রসবকালীন, প্রসব-পরবর্তী জটিলতার কারণে সৃষ্ট সংকট শুধু ওই নারীর জীবনেই অন্ধকার বয়ে আনে না, সেই সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও পোহাতে হয় অসহ্য যন্ত্রণা। একটি সুস্থ শিশুর জন্মনির্ভর একজন গর্ভবতী মহিলার গর্ভকালীন নিয়মিত চেকআপ, প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী সময়ে সুস্থতার ওপর। এ ক্ষেত্রে সেই


সুস্থতার জন্য প্রয়োজন গর্ভকালীন সময়ে গর্ভবতী মহিলার কিছু বিশেষ যত্ন ও নিয়ম পালন করা। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের কর্তাব্যক্তিরা অন্ধবিশ্বাসের কারণে গর্ভকালীন সময়ে চেকআপের জন্য অনেক মাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠান না। এখনও অধিকাংশ মা চারবার প্রসবপূর্ব সেবা (এএনসি) করান না, শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ মহিলার প্রসব হয় বাড়িতে, প্রায় ৫০ ভাগ মহিলার প্রসব করানো হয় প্রশিক্ষণবিহীন ধাত্রীর মাধ্যমে। প্রসবের দু'দিনের মধ্যে প্রসব-পরবর্তী (পিএনসি) চেকআপ না করানোর উদাসীনতা অধিকাংশ মহিলার। গ্রামাঞ্চলে মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণগুলো হলো_ অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া, অধিক সন্তানের মা হওয়া, সঠিক সময়ে টিকা না নেওয়া, স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রসব করানোর ক্ষেত্রে পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের নেতিবাচক মনোভাব। এ ছাড়াও গর্ভকালীন রুটিন চেকআপ সম্পর্কে অজ্ঞতা, গর্ভাবস্থায় ভারী কাজকর্ম বা প্রচুর পরিশ্রম করতে বাধ্য করা, পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যাপারে অসচেতনতা, প্রসবের জন্য ব্যবহৃত স্থানের ব্যবহার অনুপযোগী অবস্থা ও প্রসবের প্রস্তুতি গ্রহণের ক্ষেত্রে অসচেতনতা, নবজাতককে এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের শাল দুধ না খাওয়ানো। ৭২ ঘণ্টার আগেই গোসল দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি অজ্ঞতা আমাদের নিরাপদ শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার বাধা হয়ে আছে।
অনেক ক্ষেত্রে শুধু পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের অসচেতনতার জন্য একজন গর্ভবতী মহিলার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। অনেকের ধারণা, শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে প্রসূতি মায়ের জীবনের ঝুঁকি, নবজাতকের বাঁচামরা_ সবকিছু নিয়তি নির্ধারিত। এসব ক্ষেত্রে দারিদ্র্যের চেয়ে অসচেতনতাই দায়ী। গর্ভবতী নারীরাও মাতৃত্ব সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে এখনও ভাগ্যের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। নিয়তির কাঁধে জীবন সঁপে দিয়ে অনেকেই গর্ভধারণ করছে, মা হচ্ছে। অনেক নারীই মা হচ্ছে কিন্তু পর্যাপ্ত ও যথাযথ চিকিৎসা সেবা গ্রহণ না করায় অনেক নারী মা হওয়ার পর নানা জটিলতায় ভুগছে। অনেকে স্বাস্থ্যহানির কবলে পড়েছে। মাতৃমৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
প্রসূতি মা, নবজাতক ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কমিউনিটি পর্যায়ে তৃণমূল মানুষের মধ্যে রয়েছে কুসংস্কার। গর্ভবতী মহিলার প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী সময়সহ নবজাতকের অত্যাবশ্যকীয় সেবার জন্য করণীয় বিষয়গুলো অনেকেই গুরুত্ব দেয় না। শিক্ষিত লোকজনও অনেক ক্ষেত্রে এসব বিষয় নিয়ে উদাসীনতা প্রদর্শন করে। অনেকেই মনে করেন, প্রসব সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিতান্তই মেয়েলি ব্যাপার, এতে পুরুষের হস্তক্ষেপ দরকার নেই। অনেকে আবার একে সামাজিক লজ্জার কারণও মনে করেন।
তবে আশার কথা, সরকারিভাবে তৃণমূল পর্যায়ে কমিউনিটি প্রকল্পসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মীরা, বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থায়নে এমএনসিএস প্রকল্পের আওতায় মা, নবজাতক ও শিশুর সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের আইএমসিআই কর্মসূচির আওতায় ২০১০ সাল থেকে এমএনসিএস প্রকল্পের প্রশিক্ষিত কর্মীরা কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম, বাজিতপুর, ইটনা, করিমগঞ্জ, কটিয়াদী, পাকুন্দিয়া উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামে গর্ভবতী মা-নবজাতক ও শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কমিউনিটি পর্যায়ের মানুষকে সচেতনতামূলক কাজ করে যাচ্ছেন। বিভিন্নমুখী প্রচার, প্রশিক্ষণ ও প্রচেষ্টার কারণে তৈরি হয়েছে ইতিবাচক পরিবেশ। আমাদের প্রত্যাশা, বহু দিনের কুসংস্কার, অপধারণা, অপচিকিৎসা, পশ্চাৎপদতাকে পেছনে ফেলে গর্ভবতী নারীরা এবং পরিবারের সব সদস্য হয়ে উঠবে আরও সচেতন। ধীরে ধীরে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে আমাদের প্রিয়জনরা।
ম কিশোরগঞ্জ

No comments

Powered by Blogger.