ইটভাটা-বুড়িগঙ্গাতীর ঢেকে গেছে কালো ধোঁয়া আর ধুলায় by রফিকুল ইসলাম

রকারি হিসাবে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ধর্মগঞ্জে চারটি ইটভাটা আছে। অথচ, সরেজমিনে সেখানে এক কিলোমিটারের মধ্যেই ১২টি ইটভাটা পাওয়া গেছে। পাশের এলাকা বক্তাবলী ও চরবক্তাবলীতে সরকারি তালিকায় আছে ২১টি ইটভাটা, কিন্তু বাস্তবে আছে অন্তত ৫০টি। আবার সরকারি তালিকায় ফতুল্লা এলাকায় ৪২টি ইটভাটা থাকলেও সরেজমিনে ঘুরে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে ওই এলাকায় ইটভাটা শতাধিক। এভাবেই সরকারি নিয়ম ভেঙে


বুড়িগঙ্গাতীরে ফতুল্লার পাগলা, ধর্মগঞ্জ, বক্তাবলী, দাপা, ধোপাতিতা, ইদ্রাকপুর, আলীরটেক ও আকবরনগরে অনুমোদনহীনভাবে গড়ে উঠেছে বহু ইটভাটা। খাসজমি, কৃষিজমি, এমনকি বসতবাড়ির কাছে এসব ভাটা তৈরি করা হয়েছে।
ফতুল্লার এনায়েতনগর ইউনিয়নে বুড়িগঙ্গাতীরে ধর্মগঞ্জ থেকে ইটভাটা এলাকা শুরু। নদীতীর থেকে লোকালয়ের দিকে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা ঢেকে আছে কালো ধোঁয়া আর ধুলোয়। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ইট তৈরির এ মৌসুমে ব্যস্ত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা।
অনুমোদনবিহীন ইটভাটা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মনোজ কান্তি বড়াল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের ভিত্তিতে ইটভাটা নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়। অনুমোদনপ্রাপ্ত ইটভাটার তালিকা জেলা প্রশাসনে আছে। এর বাইরে ভাটা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।’
ফতুল্লার বক্তাবলী এলাকায় বুড়িগঙ্গাতীরে সরকারি খাসজমিতে ইটভাটা গড়ে ওঠার তথ্য প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বক্তাবলী মৌজায় ৪৭৪ একর জমির ওপর ২০টি ইটভাটা নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যক্তিমালিকানার জমির সঙ্গে খাসজমিও নেওয়া হয়েছে। এই খাসজমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখা সংশ্লিষ্ট ইটভাটার মালিকদের দুই দফায় উচ্ছেদ নোটিশ দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১৪ জন মালিক নোটিশের জবাবে প্রশাসনকে জানিয়েছেন, তাঁদের পূর্বপুরুষের এ জমি স্বাধীনতার পূর্বে এসএ রেকর্ডভুক্ত।
খাসজমিতে ইটভাটা হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সৈয়দ মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাসজমি থেকে ইটভাটা উচ্ছেদে পদক্ষেপ শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ভাটার মালিকেরা তথ্যপ্রমাণ দেখাতে না পারলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কৃষিজমি ও বসতবাড়ির কাছে ইটভাটা নির্মাণের অনুমোদন দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও ফতুল্লার ধর্মগঞ্জ ও বক্তাবলী এলাকায় এমন ভাটার সংখ্যা অনেক। এর মধ্যে ধর্মগঞ্জ এলাকার ইটভাটাগুলো বসতি এলাকার একেবারেই গা ঘেঁষে তৈরি। একসময় ধান, পাট, আখ, বাদাম, আলুসহ নানা শস্য উৎপাদিত হলেও এখন কোনো আবাদ হয় না। কৃষিনির্ভর মানুষগুলো অন্য পেশায় চলে গেছে।
জমি হারিয়ে ধর্মগঞ্জের ভাঙ্গারপাড়ে ছোট্ট মুদি দোকান নিয়ে বসা মোক্তার হোসেন (৫০) বলেন, জমিতে কোনো ফসল হয় না। কুল, আম, পেয়ারাসহ কোনো ফলই এখন আর ধরে না। একসময় বালিহাঁস, ঘুঘু, বকসহ নানা জাতের পাখি দেখা গেলেও এখন এলাকায় পাখি আসে না। হাঁস-মুরগি মরে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রথমে বুড়িগঙ্গা তীরে জেগে ওঠা চরের জমিতে ইটভাটা নির্মাণ করা হয়। পরে ভাটার মালিকেরা স্থানীয় বাসিন্দাদের ফসলি জমি ইটভাটার আওতায় নিতে শুরু করে। তারা জমি ভাড়া নিয়ে জমির ওপর থেকে মাটি কেটে ইট তৈরি করে। একপর্যায়ে উর্বরতা নষ্ট হওয়ায় জমির মালিকেরা ভাটার মালিকদের কাছে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হন।
এলাকার পরিবেশ বিপন্ন হওয়া এবং জমি হারিয়ে মানুষের নিঃস্ব হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে ধর্মগঞ্জের ভাঙ্গারপারে ইট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এএসবি ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ম্যানেজার মনির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ইটভাটার কারণে এলাকায় কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। অনেক মানুষ জীবিকার পথ খুঁজে পেয়েছেন। কারও জমি জোর করে কেনা হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.