ওআরজি-কোয়েস্ট রিপোর্ট-ভুল স্বীকার না করলে সংশোধন হবে কী করে? by মাহমুদুর রহমান মান্না

তিন বছর পার হয়ে গেল বর্তমান সরকারের। দেখতে দেখতে কেমন পেরিয়ে গেল সময়টা। তিন বছর আগে ৬ জানুয়ারি যখন এ সরকার ক্ষমতায় এল, তখনকার কথা মনে পড়ে। মানুষের কী উচ্ছ্বাস ছিল, বিশ্বাস ছিল, আশা ছিল। দিনবদলের অঙ্গীকার করেছিল আওয়ামী লীগ। মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল। সেই প্রতিশ্রুতিতে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করেছিল। ঠিক তিন বছর আগে। তিন বছরে মানুষের এ প্রত্যাশা কতখানি পূরণ হয়েছে, এ প্রশ্ন এখন সবার মনে।


প্রকৃতপক্ষে দুই-আড়াই বছর ধরে এ প্রশ্ন মানুষের মনে ছিল। কারণ, যত বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে, শুরু থেকেই তার সঙ্গে যেতে পারছিল না আওয়ামী লীগ। যেমন মন্ত্রিসভার কথা ধরি। আওয়ামী লীগ তার ম্যানিফেস্টোতে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলেছিল। কিন্তু যে মন্ত্রিসভা শপথ নিল, সেটা একটা অনিবার্য অ্যানালগ মন্ত্রিসভা। কাঠের গাইয়ের কাছে যেমন দুধ আশা করা যায় না, তেমনি অ্যানালগ মন্ত্রিসভার কাছে ডিজিটাল বাংলাদেশ আশা করা বোকামি।
ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেডের জাতীয় মতামত সার্ভে ডিসেম্বর-২০১১ প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোতে। এ সার্ভে যাঁরা পড়েছেন তাঁরা নিশ্চয় আমার ওপরের মন্তব্যের সঙ্গে একমত হবেন। যাঁরা অন্ধভাবে দল করেন, দলের ভালোমন্দ উভয়টা না দেখে অন্ধভাবে কেবল ভালোটা দেখতে ও দেখাতে চান, তাঁদের কথা আলাদা। আমাদের দেশে রাজনীতিকে এ রকমভাবে দাঁড় করানো হয়েছে, যেন কেবল দল ও নেতৃত্বের পক্ষে কথা বলাই রাজনীতি করা। ন্যূনতম সমালোচনা শুনতে রাজি নয় কেউ। একধরনের ভয়ও ঢুকে গেছে অনেকের মধ্যে। কারণ, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করা হচ্ছে। দিন যত গড়িয়েছে, হানিমুনের সময় শেষ হয়ে গেছে। এখন তো সংসার গুছিয়ে নেওয়ার পালা। হিসাব-নিকাশ করতে হবে। কী করতে পারলাম এত দিন, আর কী করতে হবে ভবিষ্যতে, তার সালতামামি প্রয়োজন।
সমালোচনা, আত্মসমালোচনা সম্পর্কে আমাদের রাজনীতি-সংস্কৃতিতে একটি নেতিবাচক ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মনে করা হয়, সমালোচনা মানে বদনাম করা, কুৎসা রটনা করা। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। বরং উন্নত গণতন্ত্রে এ রকম করে ভাবা হয় যে সমালোচনাই গণতন্ত্রের বড় বন্ধু। মানুষ নিজে নিজের ভুল বুঝতে পারে না, দেখতে পারে না। অন্যরা এ ভুল ধরিয়ে দিলেই ব্যক্তি তা বুঝতে পারে এবং ভুলটা সংশোধন করতে পারে। আর যদি ভুল কেউ ধরিয়েই না দেয়, তবে তো ভুল ভুলের জায়গাতেই থেকে যাবে। মানুষের উন্নতি হবে কীভাবে?
দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমরা সমালোচনার এ মর্মই বুঝিনি। যিনি সমালোচনা করেন, তিনি হয়তো নিন্দা করেন, আর যাঁর সম্পর্কে সমালোচনা করা হয়, তিনি রীতিমতো ক্রুদ্ধ হন। রাগ দেখান, ভয় দেখান, অতঃপর শাস্তি দেন। প্রথম আলোকে আমি ধন্যবাদ দিই, দীর্ঘদিন ধরেই তারা সমালোচনার মতো এই অপ্রিয় কাজটি করছে। কখনো কখনো হয়তো ভুলত্রুটি হচ্ছে কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রথম আলো এযাবৎকাল যা করে এসেছে, তাকে আমি গঠনমূলক বলব।
যে বিষয়ের ওপর আমি লিখছি তা কিন্তু সমালোচনা-আত্মসমালোচনা নয়। আপনারা পড়েছেন, সেটি একটি মতামত সার্ভে। পাঁচ হাজার গ্রামীণ ও শহুরে নারী ও পুরুষের ওপর তারা এ সার্ভে করেছে। তিন বছরে সরকার কী করেছে, কেমন করেছে, সরকারি দল ও তার সহযোগী সংগঠনের কার্যকলাপ কেমন ছিল, বিরোধী দলের ভূমিকা কেমন ছিল, এগুলো তাদের জানার বিষয় ছিল ওই পাঁচ হাজার মানুষের কাছে। তা ছাড়া তারা প্রশ্ন করেছিল, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য, সংসদের কার্যক্রম এবং অন্যান্য বিষয়ে। তারই ভিত্তিতে তাদের এ সার্ভে রিপোর্ট। প্রশ্ন তোলা যেতে পারে এ পাঁচ হাজার উত্তরদাতার সম্পর্কে। তাঁদের নির্বাচন করার পদ্ধতি সম্পর্কে কিংবা এমনকি তাঁদের প্রদত্ত উত্তর সম্পর্কেও। যেমন কেউ কেউ কৃষি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত রিপোর্টে খানিকটা অবাক হয়েছেন।
কীভাবে নিতে হবে এ সার্ভে রিপোর্টটিকে? অথবা যেকোনো সার্ভে রিপোর্টকে? কারও অধিকার আছে রিপোর্টটি ছুড়ে ফেলে দিতে, অথবা একেবারে না-ই পড়ে দেখতে। এ রকম তো হয় যে সার্ভে রিপোর্টও বানানো হয়। এই যে রিপোর্ট ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড তৈরি করেছে, তা দেশের কত শতাংশ মানুষ পড়ে দেখবেন? কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী অথবা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এটাকে ট্র্যাশ বলে বর্জন করতে পারেন।
সব মিলিয়ে দেশ যে পথে এগিয়ে চলছে তা সঠিক না ভুল, বর্তমান সরকার গত তিন বছরে যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, তাতে আপনি কতটুকু সন্তুষ্ট, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বর্তমান সরকার কতটা সফল বলে আপনি মনে করেন, আপনার মতে বর্তমান সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না অবনতি হয়েছে, বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতি বেড়েছে, কমেছে, নাকি একই রকম আছে বলে আপনার মনে হয়, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিচারব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, অবনতি হয়েছে, নাকি একই রকম আছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বর্তমান সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি রাখতে পেরেছে কি, যোগাযোগব্যবস্থা এবং অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নে বর্তমান সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে আপনার মতামত কী, তিন বছর আগের তুলনায় বর্তমানে আপনার জীবনযাত্রার মান ভালো হয়েছে, খারাপ হয়েছে, নাকি একই রকম আছে। বিগত বিএনপি সরকারের চেয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কি দলীয়করণ বেড়েছে, না কমেছে। গত তিন বছরে আপনি আমাদের রাজনীতিতে ভালো কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেছেন কি, গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের আচরণ (যেমন—সংসদে পত্রপত্রিকার প্রতি বিষোদ্গার, পত্রিকার প্রকাশনা রদ ইত্যাদি) কি সমর্থনযোগ্য, বর্তমান সরকার গত তিন বছরে যেভাবে সংসদ পরিচালনা করেছে তাতে কি আপনি সন্তুষ্ট, গত তিন বছরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে আপনি কতটুকু সন্তুষ্ট, আওয়ামী লীগ কি তার কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে এবং বর্তমান সরকারের আমলে কৃষি খাতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে কৃষক কি লাভবান হয়েছে? এসব প্রশ্ন করেছিল ওআরজি-কোয়েস্ট, যার সব কটির জবাব এসেছে নেতিবাচকভাবে। কেবল শিক্ষা খাত এখানে ব্যতিক্রম। প্রশ্ন করা হয়েছিল, শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সফল, নাকি ব্যর্থ হয়েছে। জবাবে ৮৯ শতাংশ বলেছেন, সফল হয়েছে। মাত্র শতকরা ৮ শতাংশ বলেছেন ভিন্ন রকম।
ওআরজি-কোয়েস্টকে আমি ধন্যবাদ দিই। তাদের প্রদত্ত সব পরিসংখ্যান বা রেখাচিত্র যে সর্বাংশে ঠিক, তা আমি বলব না। কিন্তু আমি প্রথমে বলেছি, যদি কেউ অন্ধ না হন, তাহলে তিনি মানবেন যে জবাবের এ ধারাটি প্রধানত ঠিক। সবচেয়ে বড় কথা, এটা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নয়। এটা একটা সার্ভে। আমি ধারণা করছি, এ সার্ভেটি যেদিন শেষ হয়েছে এবং যেদিন প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে কিছুদিনের গ্যাপ আছে। এ জন্যই কথাটি বলছি যে বছরের একেবারে শেষে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং শুরুতেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা এবং অব্যবহিত আগে তাঁদের হামলায় কুয়েট বন্ধ হওয়ার ঘটনা এ রিপোর্টে আসেনি। ছাত্রলীগ নিয়ে কত যে লেখালেখি হয়েছে এ তিন বছরে। কিন্তু ২০১২ সালের প্রথম প্রভাত আমাদের জানিয়ে দিল, কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়নি এই আন্দোলনের ঐতিহ্যমণ্ডিত ছাত্র সংগঠনটির ওপর।
ওআরজি-কোয়েস্ট সার্ভে করার সময় পক্ষপাতহীন থাকার চেষ্টা করেছে। এ উত্তরদাতাদের কাছে তাঁরা প্রশ্ন রেখেছেন, প্রধান বিরোধী দলের সংসদে যোগদান করা থেকে বিরত থাকাকে কি আপনি সমর্থন করেন? গত তিন বছরে প্রধান বিরোধী দল কি সংসদের বাইরে আদৌ কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে, গত তিন বছরে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে প্রধান বিরোধী দল কেমন ভূমিকা পালন করেছে। সব কটি প্রশ্নের নেতিবাচক জবাব দিয়েছেন উত্তরদাতারা। বিরোধী দল কীভাবে নেবে বিষয়টি? নিশ্চয় দেশের বিরাজিত পরিস্থিতির জন্য মানুষ সরকারকে দায়ী করবে। কিন্তু বিরোধী দলেরও একটা দায়িত্ব আছে। এটাকে বিরোধী দল (যখন যে দলই বিরোধীর ভূমিকায় থাকুক না কেন) কীভাবে দেখছে? তাঁদের অভিযোগগুলো যদি সত্যি বলে ধরি, তা হলেও সংসদ কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা আছে কি? কিংবা বিদ্যুৎ-পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে? সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোতে? ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নির্মাণে কিংবা সংজ্ঞায়িতকরণে? অযথা কোনো দায় বিরোধী দলের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছি না। কিন্তু তাদের দায়িত্ব তো আছে। সেই দায়িত্ব কী? বিরোধী দল এ ব্যাপারে কতখানি ইতিবাচক? ওআরজি-কোয়েস্টের রিপোর্টে এসব প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে প্রদত্ত জবাব দেখে বলা যায়, বাংলাদেশের জনগণ এসব নিয়ে ভাবে। বলতেই হবে, আমাদের রাজনীতি গুণগতভাবে এগোচ্ছে। জনগণ সরকারের সমালোচনা করতে ছাড়ছে না, আবার বিরোধী দলের কার্যকলাপের প্রতি তীক্ষ দৃষ্টি রাখছে। অন্ধভাবে কিছু সমর্থন করছে না।
আমার এ রকম বিশ্বাস হয় যে গণতন্ত্র বিনির্মাণের পথে বাংলাদেশের রাজনীতি এগোচ্ছে। প্রধান দুটি দলও এগোচ্ছে, কিন্তু তাদের গতি জনতার গতির তুলনায় মন্থর। বহু ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক। অন্যের সমালোচনায় অসহিষ্ণু।
ওআরজি-কোয়েস্টের শেষের তিনটি প্রশ্নে আসি। এ তিনটি প্রশ্ন হলো ১. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন। ২. বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে জাতীয় নেত্রী হিসেবে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? ৩. এখন নির্বাচন হলে আপনি কোন দলকে ভোট দেবেন?
পাঠকবৃন্দ, প্রশ্ন তিনটি খুব স্পর্শকাতর। আমাদের রাজনীতিতে প্রধান দুটি বড় দল এবং তাদের প্রধান দুই নেত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের কথা আমরা সবাই জানি। এই অবস্থায় কারও পক্ষে বলা মানেই অপরের শত্রু বনে যাওয়া। লেখালেখি কিংবা টেলিভিশনে টক শো করেন যাঁরা তাঁদের কেউ কেউ বলেন, আমরা তো কোনো দল করি না। যেটা ভুল মনে করি, সেটারই সমালোচনা করি। কিন্তু দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলেই তাঁরা আমাকে বিএনপি বলে গালাগাল দেন। আবার যখন বিএনপির সমালোচনা করি, তখন বিএনপির লোক উল্টোটা করেন। দুই দলের মাঝখানে যে একটি চিকন বা মোটা দাগ আছে এবং সেই দাগের ওপরও যে মানুষ দাঁড়াতে পারে, তা তারা বুঝতে অক্ষম।
ওআরজি-কোয়েস্টের তিনটি প্রশ্নের উত্তরই ২০১১ সালে এসে আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিপক্ষে গেছে। কীভাবে এটিকে নেবে দলটি? অবশ্য এ মন্তব্য যে জনগণের চূড়ান্ত বক্তব্য, তা বলা যাবে না। আমি আগে বলেছি, এ একই সময়ে অন্য পাঁচ হাজার লোকের মতামত ভিন্ন রকম আসতেও পারে। কিন্তু তার পরও আমি প্রস্তাব করব, আওয়ামী লীগ ও তার নেত্রী শেখ হাসিনা রিপোর্টটিকে ইতিবাচকভাবে নেবেন।
বিএনপি এবং খালেদা জিয়া সম্পর্কে আমি একটি কথা বলতে চাই, ওআরজি-কোয়েস্টের সামগ্রিক সার্ভেটি তাঁদের জন্য কিন্তু খুব ইতিবাচক কথা বলে না। জাতীয় নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়াকে মানুষ যেভাবে মূল্যায়ন করেছে, তাতে ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ সালে এসে তিনি তিন পয়েন্ট নেমে গেছেন।
এ জন্যই বলতে চাই, উভয়কে, উভয় দলকে আরও ভালো করতে হবে।
মাহমুদুর রহমান মান্না: রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.