গণিত উৎসব-গণিত শিখে দেশ গড়ার অঙ্গীকার

ণিত জয়ের স্বপ্ন নিয়ে ছুটির দিনের সকালে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে হাজির হয়েছিল ওরা সবাই। উদ্দেশ্য, ‘গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো’ শীর্ষক স্বপ্নযাত্রায় অংশ নেওয়া। ওরা হচ্ছে দশম ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো ঢাকা-২ আঞ্চলিক গণিত উৎসবে অংশ নেওয়া এক হাজার ২২০ শিক্ষার্থী। উৎসবে যোগ দিয়ে খুদে গণিতবিদেরা অঙ্ক শিখে সবাই মিলে দেশ গড়ার এবং মাদক, মুখস্থ ও মিথ্যাকে ‘না’ বলার অঙ্গীকার করেছে। মজার ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন, নাচ-গান-আবৃত্তি ও


রুবিক কিউবের প্রতিযোগিতায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে উৎসব। অংশ নেয় গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা মহানগরের ১৩৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড এই উৎসবের আয়োজন করে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান: সকাল সাড়ে নয়টায় রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহা. গোলাম হোসেন সরকার জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে উৎসবের উদ্বোধন করেন। উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড ও আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকাও। ওড়ানো হয় বেলুন।
এই পর্বে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুল হাসান বলেন, ‘গণিত অলিম্পিয়াড দেশের শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে এক অনন্য উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক সব সময় এই উদ্যোগের সঙ্গে থাকতে পেরে গৌরব বোধ করে। বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিভিত্তিক সমাজ গঠন করতে গণিতভীতি দূর করতে হবে।’
সোয়া এক ঘণ্টার গণিত পরীক্ষার পর শুরু হয় বিশেষজ্ঞদের প্রতি শিক্ষার্থীদের চমকপ্রদ প্রশ্ন, গান, নৃত্য, আবৃত্তি ও শপথের পালা। এসব আয়োজন চলে বিকেল পৌনে চারটা পর্যন্ত। বিকেলে সমাপনী পর্বে চার ক্যাটাগরিতে সেরা ৬০ জন শিক্ষার্থীকে পুরস্কার দেওয়া হয়।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: পরীক্ষা পর্বের পর ‘আয় আয় গণিতের আঙিনায়’ এই গান দিয়ে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পর্ব। প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা গান-নাচ-আবৃত্তি দিয়ে সবাইকে মাতিয়ে দেন। ‘নোঙর তোলো তোলো’ গান পরিবেশন করেন ঢাকা বন্ধুসভার সদস্যরা। ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব’ ও ‘এসো বাংলাদেশের যত বীর জনতা’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন মিরপুর বন্ধুসভার সদস্যরা।
প্রশ্নোত্তর পর্ব: উৎসবের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্ব ছিল খুদে গণিতবিদদের প্রশ্ন। এই পর্বে চমকপ্রদ সব প্রশ্ন ছুড়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। শূন্য দেখতে গোলাকার কেন, ডলফিন পানিতে লাফ দেয় কিন্তু হাঙর কেন দেয় না, জ্যামিতিকে কেন গণিতের অংশ বলা হয়, ছোটদের অলিম্পিয়াড হয় না কেন, স্বপ্ন দেখি কেন ও বেশি পড়লে মাথাব্যথা করে কেন ইত্যাদি মজার মজার প্রশ্নের জবাব দিয়ে তাদের কৌতূহল মেটানোর চেষ্টা করেন বিশিষ্ট অতিথিরা।
শিক্ষার্থীদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সভাপতি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, সহসভাপতি অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, গণিতবিদ অধ্যাপক খোদাদাদ খান, অধ্যাপক আবদুল হাকিম খান, হুমায়ূন কবীর ও মনোরোগ চিকিৎসক মোহিত কামাল। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান।
মধ্যাহ্নবিরতির পর রুবিক কিউব মেলানোর প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা। এতে বিজয়ী তিন শিক্ষার্থীকে পুরস্কৃত করা হয়।
গণিত শিখে দেশ গড়ার আহ্বান: অনুষ্ঠানে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ‘শুধু অলিম্পিয়াডের জন্য নয়, গণিত শিখে যেন দেশের আর্থসামাজিক উন্নতি করতে পারি।’
অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, ‘জ্ঞান হচ্ছে সম্পদ। আমাদের দরকার জ্ঞান। তাহলে বাংলাদেশ সম্পদশালী হয়ে যাবে। গণিত শিখে তোমরা দেশটা তৈরি করবে ও এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
অধ্যাপক খোদাদাদ খান বলেন, ‘গণিতের প্রাণ অনুশীলন। গণিত ছাড়া কিছুই চলে না। সব সময় প্রশ্ন করবে।’
প্রথম আলোর উপসম্পাদক আনিসুল হক শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘যারা গণিত করতে এসেছে, তারা আলোর টুকরা। আমরা সবাই মিলে এই দেশটাকে গড়ে তুলব।’ শিক্ষার্থীরা হাত তুলে তাঁর কথায় সায় দেয়।
উৎসবে হায়ার সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পাওয়া মাহাথীর আহমাদের মা শরীফা মহী প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণিত অলিম্পিয়াড শিশু-কিশোরদের দক্ষতা ও মেধা যাচাইয়ের জন্য সহায়ক। এটা ভালো উদ্যোগ।’
মেলার আমেজ: কলেজের মাঠে বিজ্ঞান ও গণিতবিষয়ক বই নিয়ে স্টল খোলা হয়। বাংলা উইকিপিডিয়াকে সমৃদ্ধ করতে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কও স্টল দেয়। এ ছাড়া ছিল প্রথম আলোর প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রথমা’র স্টল। বন্ধুসভার স্টলে ভিড় জমান অনেকেই। এ ছাড়া ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল অ্যান্ড হেলথ টেকনোলজির উদ্যোগে বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা ও প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থাও ছিল।
অনুষ্ঠানজুড়ে শিশু-কিশোরদের প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে কাছে পেয়ে অটোগ্রাফ নিতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।
সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণ: পুরস্কার বিতরণের আগে সমাপনী পর্বে মুনির হাসান মাদক, মুখস্থ ও মিথ্যাকে ‘না’ বলার অঙ্গীকার করান। এরপর ‘আমরা করব জয়’ শীর্ষক উদ্দীপনামূলক গানের মাধ্যমে শুরু হয় সমাপনী পর্ব। বন্ধুসভার পরিবেশনায় গানে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে কণ্ঠ মেলায় উৎসবে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা।
এরপর প্রাইমারি, জুনিয়র, সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে মোট ৬০ জন শিক্ষার্থীর হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, ১৭টি আঞ্চলিক উৎসবের সেরা গণিতবিদদের নিয়ে আগামী ১০ ও ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় গণিত উৎসব, ২০১২ ও দশম বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড। তাদের মধ্যে সেরা কয়েকজন এ বছরের জুলাই মাসে আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে পারবে।

No comments

Powered by Blogger.