তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠন ইস্যুতে কংগ্রেস উভয় সঙ্কটে by আহমেদ জামিল

ভারতের রাজনীতিতে উগ্র প্রাদেশিকতাবাদের কারণে জাতীয়ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি আঞ্চলিক দলগুলোও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রদেশগুলো ভেঙে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি। মূলত ভাষা, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক কারণে নতুন রাজ্য গঠনের দাবি দিন দিন জোরদার হচ্ছে।

সম্প্রতি ভারতের দক্ষিণের অন্ধ্র প্রদেশ ভেঙে তেলেঙ্গানাকে ২৯তম রাজ্য করার কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগের প্রেক্ষিতে ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ ইস্যুতে শুধু ক্ষমতাসীন কংগ্রেসই নয়, অন্যান্য দল এবং জোটের মধ্যেও বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে। বামফ্রন্টও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার গত ৯ ডিসেম্বর তেলেঙ্গানাকে আলাদা রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণা দেয়।
অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্যের বিধানসভায় দ্রুত এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাব তোলার কথা বলা হয়। আলাদা রাজ্য হিসেবে ঘোষণার দাবিতে তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির প্রধান কে চন্দ্র শেখর রাওয়ের আমরণ অনশনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রসঙ্গক্রমে বলা হচ্ছে, অন্ধ্র প্রদেশ থেকে আলাদা করে পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের দাবি অনেক পুরনো, প্রায় ৫০ বছরের। অন্ধ্র প্রদেশের উত্তরাঞ্চলের ১০টি জেলা নিয়ে নতুন এ তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের কথা। ভূতপূর্ব হায়দরাবাদ রাজ্যের অন্তর্গত এ ১০ জেলা। ভারতের আর সব সমৃদ্ধিশালী প্রদেশের মতোই অন্ধ্র প্রদেশেও রয়েছে বৈষম্য। রয়েছে বিশাল সমৃদ্ধির পাশাপাশি সীমাহীন পশ্চাত্পদতা ও দারিদ্র্য। ভারতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পঞ্চাত্পদ, অনুন্নত ও খড়াপীড়িত অঞ্চল নিয়ে আলাদা রাজ্য গঠনের দাবি জোরদার হয়ে উঠেছে। নতুন রাজ্যের সমর্থকদের বক্তব্য হলো, তারা রাজ্য সরকারের দ্বারা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত এবং বৈষম্যের শিকার।
অন্ধ্র প্রদেশ থেকে তেলেঙ্গানার বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উদ্যোগের নেপথ্যেও এ ধরনের কারণ কাজ করছে। তেলেঙ্গানার জনগণকে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কংগ্রেস অন্ধ্র প্রদেশে চন্দ্র বাবু নাইডুর তেলেগু দেশম, টিডিপি ও বিজেপি কোয়ালিশন সরকারকে হটিয়ে ২০০৪ সালে সরকার গঠন করতে পেরেছিল। একই বছর কংগ্রেস লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে অনেক আসন পেয়েছিল। ২০০৯’র সাধারণ নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
একথা সত্য যে, ভারতে একাধিক প্রদেশ ভেঙে একাধিক রাজ্য গঠনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। এ প্রক্রিয়ার সূচনা ১৯৫৩ সাল থেকে। তবে বিষয়টি সব সময় সহজসাধ্য ছিল না। এক্ষেত্রে দক্ষিণের আরেক প্রদেশ মাদ্রাজের কথা বলা যেতে পারে। ৫০-এর দশকে মাদ্রাজের প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় কংগ্রেস নেতা ছিলেন শ্রী রামালু। তিনি মাদ্রাজের তেলেগু ভাষীদের জন্য একটি পৃথক রাজ্য গঠনের দাবিতে ১৯৫২ সালের ১৯ অক্টোবর থেকে আমরণ অনশন ধর্মঘট করেন। ৫৬ দিন অনশন করার পর তার মৃত্যু হয়।
তার মৃত্যুর পর শুরু হয় প্রবল গণআন্দোলন, যা এক পর্যায়ে মারাত্মক সহিংস রূপ ধারণ করে। এই প্রবল সহিংস গণআন্দোলনের মুখে সকরার দাবি মেনে নেয় এবং সমগ্র ভারতে ভাষার ভিত্তিতে প্রথম একটি রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশ গঠিত হয়। অর্থাত্ ১৯৫৩ সালে অন্ধ্র প্রদেশের জন্ম হয় মাদ্রাজ থেকে পৃথক হয়ে। পরবর্তী সময় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ভেঙে একাধিক রাজ্য গঠন করা হয়েছে। তথ্য সূত্র মতে, রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ১৯৫৪ সালে সুপারিশ করেছিল ভাষাভিত্তিক ১৬টি রাজ্য গঠনের। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সেখানে ১৪টি রাজ্য গঠন করে। এ ১৪টি রাজ্য হলো ঃ ১. অন্ধ্র প্রদেশ; ২. বোম্বাই; ৩. মহারাষ্ট্র; ৪. গুজরাট; ৫. জম্মু ও কাশ্মীর; ৬. কেরালা; ৭. মধ্যপ্রদেশ; ৮. মাদ্রাজ; ৯. মহীশূর; ১০. উড়িষ্যা; ১১. পাঞ্জাব; ১২. রাজস্থান; ১৩. উত্তর প্রদেশ; ১৪. পশ্চিমবঙ্গ। তবে ভাঙনের প্রক্রিয়া এখানে এসেই থেমে থাকেনি, তা অব্যাহত রয়েছে এবং থাকবে। এ যেন চলমান প্রক্রিয়া।
এই চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পরবর্তী সময় মাদ্রাজকে আরও ভাঙা হলো। গড়া হলো তামিলনাড়ু ও কেরালা। পাঞ্জাবকে ভেঙে গঠন করা হলো হরিয়ানা রাজ্য। আসাম ভেঙে হলো নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মেঘালয় এবং অরুণাচল। সমরাভিযান চালিয়ে জোরপূর্বক সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে আরেকটি আলাদা রাজ্য বানানো হলো। বিভক্তি হলো আরও। গঠিত হলো ছত্তিশগড় ও ঝাড়খণ্ড। ২০০২ সালে উত্তর প্রদেশ ভেঙে গঠিত হয় উত্তরাখণ্ড রাজ্য। আর বর্তমান সময়ে অন্ধ্র প্রদেশ ভেঙে পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গড়ার উদ্যোগ আয়োজন চলছে। আর এ ইস্যুতে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অন্ধ্র প্রদেশ কংগ্রেস এখন তেলেঙ্গানা ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত। পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য ইস্যুতে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস কেন্দ্রে এবং রাজ্যে গভীর সঙ্কটে পড়েছে। এরই মধ্যে অন্ধ্র রাজ্য সভায় যে ১৩৫ জন এমএলএ পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন তার মধ্যে ৭৯ জনই শাসক কংগ্রেস দলের। মুখ্যমন্ত্রী কে রোসাইয়া পদত্যাগ করবেন কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। শুধু তাই নয়, এ ইস্যুতে বামফ্রন্টেও বিভক্তি লক্ষ্য করা যায়। সিপিএম অখণ্ড অন্ধ্র রাজ্যের পক্ষে থাকলেও সিপিআই পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্যের পক্ষে। তবে সিপিআই নেতা এবি বর্ধন সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি পৃথক গোর্খাল্যান্ডের পক্ষে নন।
অন্ধ্র প্রদেশকে বিভক্ত করার পক্ষে-বিপক্ষে সহিংস আন্দোলন এবং এ ইস্যুতে কংগ্রেসের বিভক্তির ঘটনায় ভীষণ নাজুক অবস্থায় পড়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম। কারণ পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের ঘোষণাটি এসেছিল তার তরফ থেকে। তার এ ঘোষণায় শুধু অন্ধ্র নয়, ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও পৃথক হওয়ার প্রবণতা আরও জোরেসোরে শুরু হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের জের ধরে ভারতের নয়টি রাজ্য ভেঙে অন্তত ১৭টি নতুন রাজ্য গঠনের দাবি উঠেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পশ্চিমবঙ্গ ভেঙে পৃথক দার্জিলিং জেলা এবং সন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে গোর্খাল্যান্ড রাজ্য এবং পশ্চিমবঙ্গের ছয়টি জেলা ও আসামের ১৫টি জেলা নিয়ে কামতাপুর বা গ্রেটার কুচবিহার রাজ্য গঠনের দাবি উঠেছে। রাজস্থান ভেঙে মরু প্রদেশ গঠনের দাবিও এখন তীব্র হয়েছে। অন্যদিকে দাবি উঠেছে মহারাষ্ট্র ভেঙে আলাদা বিদর্ভরাজ্য গঠনের। এদিকে উত্তর প্রদেশের বহুজন সমাজ পার্টি নেত্রী মায়াবতী উত্তর প্রদেশের পূর্ব দিকের কিছু অংশ নিয়ে ‘পূর্বাঞ্চল’ রাজ্য গঠনের দাবি জানিয়েছেন। এছাড়াও আসাম ভেঙে বোরোল্যান্ড ও দিমারাজি রাজ্য গঠনের জন্য শুরু হয়েছে জোর আন্দোলন। দাবি উঠেছে গুজরাট ভেঙে সৌরাষ্ট্র রাজ্য, তামিলনাড়ু ভেঙে দক্ষিণের জেলা নিয়ে মাদুরাই রাজ্য, জম্মু-কাশ্মীর ভেঙে জম্মু রাজ্য, মধ্যপ্রদেশ ভেঙে বিন্ধ্যাচল রাজ্য, পাঞ্জাব ভেঙে পেপসু রাজ্য, কর্ণাটক ভেঙে মহীশূর রাজ্য এবং উড়িষ্যা ভেঙে আরও দুটো পৃথক রাজ্য কলিঙ্গ ও কোশল রাজ্য গঠনের। যা হোক, রাজ্যে এ ধরনের ভাঙনের খেলা ভারতের ঐক্য, সংহতি এবং অখণ্ডতার প্রশ্নটি পরোক্ষভাবে হলেও সামনে নিয়ে এসেছে। অর্থাত্ পৃথক রাজ্যের দাবি বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতার প্রাথমিক পর্যায় বলা যেতে পারে। যে কারণে ভারতের ক্ষমতাসীনরা এনিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
যার প্রেক্ষিতে তেলেঙ্গানা ইস্যুকে ঘিরে সৃষ্ট সঙ্কট এবং কংগ্রেসের অনৈক্য ইত্যাদি মীমাংসার প্রক্রিয়া থেকে দায় এড়ানোর কৌশল হিসেবে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং নিজেকে দূরে রাখতে চাচ্ছেন। আর কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী এ ব্যাপারে নিজেকে কোনোভাবেই জড়াতে চাচ্ছেন না। বিষয়টির পুরো দায়ভার গিয়ে পড়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের ওপর। যে কারণে পি চিদাম্বরম বলতে বাধ্য হয়েছেন, শুধু পৃথক গোর্খাল্যান্ড নয়, আর নতুন কোনো রাজ্যের ঘোষণা আপাতত দেয়া হবে না। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের বিষয়টি অন্ধ্র প্রদেশ বিধানসভার ঘাড়ে চাপাতে চাইলেও এ রাজ্যের বিধানসভা এ প্রশ্নের সুরাহার সব দায়দায়িত্ব কেন্দ্রের হাতে ছেড়ে দিতে চাচ্ছে। হয়তো এ কারণে কেন্দ্রে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠন ইস্যুতে ধীরে চল নীতি অনুসরণ করতে চাচ্ছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ আবার একথাও বলছেন যে, চিদাম্বরমের ঘোষণার পরই তেলেঙ্গানা আলাদা রাজ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়ে গেল তা ভাববার কোনো কারণ নেই।
কারণ আলাদা তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের ব্যাপারে অন্ধ্রে প্রভাবশালী দুটি রাজনৈতিক দল কংগ্রেস এবং তেলেগু দেশম পার্টির মধ্যে কোনো মতৈক্য নেই। তাছাড়া অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী হায়দরাবাদও প্রস্তাবিত তেলেঙ্গানা রাজ্যের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে, যা রাজ্যের প্রভাবশালী মহলের একাংশ মানতে নারাজ। আবার এ ব্যাপারে চন্দ্র শেখর রাওয়ের ছেলে কেটি রামারাও বলেছেন, হায়দরাবাদ ছাড়া তেলেঙ্গানা রাজ্য কল্পনা করা অসম্ভব। যাহোক, একথা সত্য যে, তেলেঙ্গানা নিয়ে কংগ্রেস হাইকমান্ড এখন উভয় সঙ্কটে পড়েছে। পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের সিদ্ধান্ত বাতিল করা কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের জন্য অসম্ভব ব্যাপার। তাতে করে তেলেঙ্গানায় কংগ্রেস পায়ের তলার মাটি হারাবে। আর তেলেঙ্গানা আলাদা রাজ্য হলে কংগ্রেসের একই দশা হবে অন্ধ্র প্রদেশে। সঙ্কট সামাল দেয়ার জন্য ইউপিএ সরকার রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করার কথা ভাবছে বলে শোনা যাচ্ছে।
তাই শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা কংগ্রেস নেতৃত্ব কীভাবে সামাল দেবেন সেটিই এখন দেখার বিষয়।
লেখক : কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.