শিক্ষকদের সৃজনশীলতা বিকাশ-শিক্ষা by শেখ শাহবাজ রিয়াদ

শিক্ষার গুণগত ও পরিমাণগত উন্নয়নের জন্য মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক ও বিষয়, উপযুক্ত শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি, উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি ও আনন্দদায়ক বিদ্যালয়-পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে খুবই সজাগ ও দায়িত্বশীল। বিগত এক দশক ধরে এ সত্যটির গুরুত্ব বিবেচিত হওয়ার ফলে নানাবিধ শিক্ষক প্রশিক্ষণের পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে।


একমাত্র টিচিং কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন প্রজেক্টের আওতায় ২০১১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষককে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সংখ্যাগতভাবে যা আড়াই লাখেরও বেশি। এ প্রশিক্ষণটি ধারাবাহিক পেশাগত উন্নয়ন বা সিপিডি নামে পরিচিত। সিপিডি প্রশিক্ষণে শিক্ষকদের শিক্ষণ কলাকৌশলের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হলেও আরও কিছু সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রশিক্ষণ শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন একীভূত শিক্ষা, জেন্ডার সচেতনতা, বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্য যাচাই, সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন ইত্যাদি। কোনো কোনো প্রকল্প অবশ্য নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। টিকিউআই-সেপ প্রকল্প ছাড়াও আরও কয়েকটি প্রকল্প মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ফলে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের গুণগত শিক্ষার জন্য তৈরি করার যে পদক্ষেপ তা যথার্থভাবেই এগিয়ে চলছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কিন্তু এতসব প্রশিক্ষণ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান, দক্ষতা ও মূল্যবোধকে কাজে লাগানোর মতো সুযোগ শিক্ষকদের আছে কি-না তা নিয়ে শিক্ষক-প্রশিক্ষক ও নীতিনির্ধারক মহলে ভিন্ন ভিন্ন মতামত আছে। নীতিনির্ধারক বা প্রশাসনিক মহল চায় কোনো একটি প্রশিক্ষণের প্রত্যাশিত সব উদ্দেশ্যই পুরোপুরি অর্জিত হোক। তারা সাধারণত কোনো ধরনের অজুহাত বা সমস্যা শুনতে চান না। প্রশিক্ষক হিসেবে আমরা অবশ্য সে কথাটিই পুনরাবৃত্তি করি এবং তাদের কাজে জাতির প্রত্যাশার কথা তুলে ধরি। নানাবিধ যুক্তি, সহানুভূতি দিয়ে এবং শিক্ষকদের সব অভিমান-অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে প্রশিক্ষণলব্ধ সব অর্জনকে কাজে লাগানোর কথা যখন বলা হয় তখন যে সত্যটি বেরিয়ে আসে তা হলো, শিক্ষকদের সৃজনশীলতার বিকাশ, চর্চার সীমাবদ্ধতা ও স্থবিরতার চিত্র। প্রশিক্ষণের বিষয়, বিষয়বস্তু ও কলাকৌশল যত আধুনিক ও মানসম্মত হোক না কেন, বাস্তবে যদি তা প্রয়োগের সুযোগ ও ক্ষেত্র না থাকে তাহলে প্রশিক্ষণের ফল অর্জিত হবে না। বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষকদের সৃজনশীলতার প্রকাশ, বিকাশ ও চর্চার পথে বেশ কয়েকটি বাধা রয়েছে। গতানুগতিক পাঠ্যসূচি, নম্বর ও গ্রেডমুখী মূল্যায়ন পদ্ধতি, বিষয়ভিত্তিক ও সামষ্টিক শিক্ষকস্বল্পতা, অধিক ক্লাস ও কাজের চাপ, লেখালেখি ও গবেষণার বাধ্যবাধকতা ও সুযোগ না থাকা, আর্থিক ও সামাজিক স্বীকৃতির অভাব এবং স্থবির পেশাগত উন্নয়ন সম্ভাবনা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি। একজন শিক্ষককে প্রতিদিন নির্ধারিত রুটিন অনুযায়ী ৭-৮টি ক্লাসের মধ্যে নূ্যনতম ৫টি ক্লাস নিতে হয়। তার সঙ্গে যোগ হয় প্রতিদিনের অস্থায়ী রুটিন যা স্টপ-গেপ নামে পরিচিত। ফলে অধিকাংশ শিক্ষককে বিদ্যালয়ের প্রথম ঘণ্টা থেকে শেষ ঘণ্টা অবধি বিরতিহীনভাবে ক্লাস নিতে হয়। ফলে প্রতিদিনের ক্লাসের সংখ্যাগত দিকটি নিশ্চিত করা গেলেও গুণগত ও সৃজনশীলতার দিকটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে এ দিকটি স্পষ্টভাবে উন্মোচিত হয়। উল্লেখ্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের টিকিউআই-সেপ প্রকল্পের অধীন বিদ্যালয় পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনাকালীন আকস্মিক পরিদর্শনের সময় অধিকাংশ বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষককে পাঠ পরিকল্পনাহীন, শিক্ষণ-সহায়ক উপকরণ ব্যতীত ক্লাস পরিচালনা করতে দেখা যায়। কারণ হিসেবে তারা সাধারণত প্রতিদিনের অধিকসংখ্যক ক্লাস, বিরতিহীন ক্লাস ও বিভিন্ন বিষয়ের ক্লাস নেওয়াকে উল্লেখ করে থাকেন। এ কথা সত্যি যে, একজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও বিএড কোর্সে লব্ধ দুটি বিষয়ের প্রশিক্ষণের বাইরেও অনেক বিষয়ের ক্লাস নিতে হয়। যার কারণে প্রতিটি ক্লাসের জন্য উপকরণ তৈরি, সংরক্ষণ ও বিদ্যালয়ে নিয়ে আসার মতো মানসিকতা তৈরি হয় না। ফলে তাদের মধ্যে পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠে না। এ ক্ষেত্রে অধিক ক্লাস এবং বিভিন্ন বিষয়ের ক্লাস তার পেশাদারিত্ব ও সৃজনশীলতা বিকাশে বাধা হিসেবে কাজ করে। অধিকন্তু শিক্ষকদের একটি শ্রেণী যা শিক্ষকতাকে মনে-প্রাণে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছে, তারা শুধু ক্লাস রুটিনের দুর্বলতা, ক্লাস বণ্টনে বৈষম্য, অধিক ক্লাসের চাপ এবং সর্বোপরি সামাজিক মর্যাদা ও কর্মের যথাযথ স্বীকৃতির অভাবে মানসিকভাবে দুর্বল, অযোগ্যদের কাছে কোণঠাসা হয়ে নিজেদের সৃজনশীলতা প্রকাশ ও বিকাশের চর্চা থেকে নিজেদের দিনের পর দিন গুটিয়ে নিচ্ছেন। অন্যদিকে আরেকটি শ্রেণী, যাদের পেশার প্রতি, সমাজের প্রতি এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ, তারা বিদ্যালয়ের ক্লাস রুটিন তৈরি ও বিষয়বস্তু বণ্টনসহ বিদ্যালয়ের সব অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজেদের প্রাধান্য সর্বদা বজায় রেখেছে। এরূপ বিভিন্নমুখী বিচ্যুতি ও অসঙ্গতির কারণে শিক্ষক সমাজের এই অংশটি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ক্লাসের বদলে প্রাইভেট টিউশন এবং বিদ্যালয়ের বদলে কোচিং সেন্টারকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মানবিকতা ও আদর্শমুখী হওয়ার বদলে নম্বরমুখী করে গড়ে তুলছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের প্রতিভা ও সৃজনশীলতা বিকাশের পূর্বশর্ত হচ্ছে সত্যিকারের প্রতিভাবান ও সৃজনশীল শিক্ষক সমাজ।

শেখ শাহবাজ রিয়াদ : সহকারী অধ্যাপক সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা
riadisrat1971@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.