গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই স্বস্তি-আরেক আলোকে by ইনাম আহমেদ চৌধুরী

সোমবারের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে খোদ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এর মধ্য দিয়ে এ দেশের নাগরিকরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা পুনর্ব্যক্ত করেছে। আমি আশা করি, আগামী দিনগুলোতে এই শান্তি ও সহাবস্থান বজায় থাকবে।


সবারই মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক শক্তিগুলোর পারস্পরিক সৌহার্দ্যই হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার একমাত্র উপায়

নির্ধারিত সময়ের একদিন পরে হলেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির গণমিছিল শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি স্বস্তিকর। বস্তুত এই আয়োজন নিয়ে অনেকের মনেই শঙ্কা ছিল। কারণ এই গণমিছিল নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক জল ঘোলা হয়েছে। নির্ধারিত দিন রোববার ঢাকায় কর্মসূচি না থাকলেও বিভিন্ন জেলা সদরে মিছিল হয়েছে। লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরে চারজন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছে অনেকে। ফলে সোমবারের গণমিছিলে শেষ পর্যন্ত কী হয় তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কও ছিল। তবে এই আতঙ্ক স্বাভাবিক নয়। বলা চলে সরকারই এমন ভীতিকর পরিবেশ ও পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।
সবাই জানেন, এ মাসের ৯ তারিখে চট্টগ্রামের পলো গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত জনসভায় চারদলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়া ২৯ তারিখ গণমিছিল অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথমে সরকার নাশকতার ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করে এবং পরে ক্ষমতাসীন দল একই দিনে ঢাকায় জনসভার ঘোষণা দেয়। একপর্যায়ে আরোপ করা হয় মিছিল-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা। ওই নিষেধাজ্ঞা পুলিশের পক্ষ থেকে ঘোষিত হলেও আসলে যে সরকারেরই ইশারায়, তা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
অন্যদিকে পুরো ইস্যুতে বিএনপি অত্যন্ত রাজনৈতিক পরিপকস্ফতার পরিচয় দিয়েছে। বিএনপি নেতৃত্ব ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। শান্তিপূর্ণ মিছিল সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে পাল্টা কঠোর কর্মসূচি দেওয়াই আমাদের দেশের রাজনৈতিক রেওয়াজ। কিন্তু দলটি বরং কর্মসূচি একদিন পিছিয়ে দিয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি_ এতে বিএনপিই লাভবান হয়েছে। শান্তিপ্রিয় নাগরিকের কাছ থেকে বিরোধী দল নীরব সমর্থন পেয়েছে।
অবশ্য সোমবারের কর্মসূচি নিয়ে শঙ্কা থেকেই গিয়েছিল। কারণ মহানগর আওয়ামী লীগও তাদের কর্মসূচি একদিন পিছিয়েছিল। অথচ তাদের উচিত ছিল বিষয়টি নিয়ে আর পাল্লা না দেওয়া। দু'একদিন পিছিয়ে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা। তাতে আর কিছু হোক না হোক, রাজনৈতিক শিষ্টাচার প্রদর্শিত হতো। সবকিছুর পর স্বস্তির কথা এই যে, দুই দলের আয়োজনের মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি না থাকলেও আমার জানা মতে উল্লেখযোগ্য গোলযোগ হয়নি। এর একটি কারণ হতে পারে বিএনপির গণমিছিলের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের ব্যাপক সমর্থন।
আমি নিজে গণমিছিলে অংশ নিয়েছিলাম। দুপুর ১টার দিকে যখন বিএনপি কার্যালয়ের কাছে পেঁৗছাই, তখন লোকজন কেবল আসতে শুরু করেছে। ২টা-আড়াইটার মধ্যে গোটা এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। যেন জনসমুদ্র। কত হতে পারে, আমি আন্দাজ করতে পারিনি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যখন এলেন, তখন তিল ধারণের জায়গা ছিল না। স্বভাবতই অন্য কেউ বক্তব্য দেননি। অভিন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশনের ভূতপূর্ব মেয়র সাদেক হোসেন খোকা সভাপতিত্ব করেন এবং সংক্ষিপ্ত বক্তব্য প্রদান করেন। খালেদা জিয়ার বক্তব্যও তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত ছিল। কিন্তু তিনি তার মধ্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরে হত্যাকাণ্ড এবং সারাদেশে পুলিশি নির্যাতন ও ধরপাকড়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়েছে বটেই; পাশাপাশি জোর দিয়েছেন শান্তি-শৃঙ্খলার ওপর। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের সময় যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলোর একটিও যে রক্ষা করছে না, সে বিষয়টিও পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
কিছু আগের ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের সঙ্গে বিএনপিকে জড়িয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, তারও স্পষ্ট জবাব দিয়েছেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, তার দল সেনা অভ্যুত্থানের সঙ্গে কখনও জড়িত ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকবে না। আওয়ামী লীগই বরং বারবার সেনা অভ্যুত্থানে মদদ জুগিয়েছে। তার এ কথা সত্যি। আমাদের মনে আছে, ১৯৭৫ সালের মর্মন্তুদ পট পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত ছিল আওয়ামী লীগেরই কিছু নেতা। খালেদা জিয়া গণমিছিলপূর্ব সমাবেশে বলেছেন, ওই ঘটনার পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তার মন্ত্রিসভাতেও আওয়ামী লীগের নেতারাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। খালেদা জিয়া বলেছেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন বিচারপতি আবদুুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল, তখন আওয়ামী লীগ সেটাকে স্বাগত জানিয়েছিল। তিনি সমাবেশে বলে দিয়েছেন_ সেনা নয়, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার হটাবে বিএনপি।
সোমবারের সমাবেশে খালেদা জিয়া বলেছেন বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচনে যেতে চায় না। কারণ কেবল বিএনপি নয়, সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোই নয়, নাগরিক সমাজও এই পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। দেশের মানুষ এই ব্যবস্থার পক্ষে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সরকারি দলও গণতন্ত্রের পথে আসবে। তিনি যদিও বলেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না; আমার কাছে মনে হচ্ছে, তিনি একই সঙ্গে নির্বাচনের দিকেও তাকাচ্ছেন। তাকে দেখে মনে হয়েছে, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল হবেই এবং নির্বাচনের জাতীয়তাবাদী শক্তিই বিজয়ী হবে।
বস্তুত এই গণমিছিলের মধ্য দিয়ে বিএনপির অবস্থান আগের চেয়ে সংহত হয়েছে। শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে এই দলের অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়েছে। বিএনপি যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকারের অগ্রহণযোগ্য অবস্থান ও পদক্ষেপের জবাব ভালোভাবে দিতে পারে, তা প্রমাণ হয়েছে। কেবল বিএনপির নয়, এই ধরনের কর্মসূচির মধ্যে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের জন্যও শিক্ষণীয় অনেক কিছু রয়েছে। চাইলেই যে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচি কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারে না, তা আরেকবার প্রমাণ হলো।
সোমবারের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে খোদ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এর মধ্য দিয়ে এ দেশের নাগরিকরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা পুনর্ব্যক্ত করেছে। আমি আশা করি, আগামী দিনগুলোতে এই শান্তি ও সহাবস্থান বজায় থাকবে। সবারই মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক শক্তিগুলোর পারস্পরিক সৌহার্দ্যই হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার একমাত্র উপায়।

ইনাম আহমেদ চৌধুরী : সাবেক সচিব ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.